ভাবাদর্শ, মতাদর্শ বা অধিবিদ্যা (গ্রিক ιδεολογία শব্দ হতে) (ইংরেজি: Ideology) হচ্ছে বিশ্বাস, আদর্শ ও মূল্যবোধের সমষ্টি যা একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তির বাইরে গিয়ে ধারণ করে। এটি বাস্তবতা সম্পর্কিত মৌলিক পূর্বানুমানের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে যার কোন বাস্তবিক ভিত্তি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। এটি এক ধরনের সচেতন এবং অসচেতন ধারণা যা ব্যক্তির বিশ্বাস, লক্ষ, প্রত্যাশা, এবং প্রেরণার সমষ্টি হিসাবে বর্ণনা করা যায়। এই শব্দটি বিশেষভাবে ধারণা ও আদর্শের একটি ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে, যেখান থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং সেখান থেকে উদ্ভূত নীতিমালার ভিত্তি তৈরি হয়। এই রাষ্ট্রীয় নীতিমালাসমূহ এবং এগুলোর ফলে সৃষ্ট ফলাফলগুলোর মধ্যে খুব দুর্বল কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে, কেননা এখানে প্রচুর চলকের উপস্থিতি থাকে। এত বেশি চলকের উপস্থিতির কারণে কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে কোন ফলাফল আসবে তা নির্ধারণ করা জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর একারণে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পূর্বানুমান তৈরি করতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এই পূর্বানুমানগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই শব্দটিকে রাজনৈতিক বিশ্বাস ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এই শব্দটি (Ideology) প্রথম চালু করেন আঁতোয়া দেসতুত দে ট্রেসি নামক একজন ফরাসী জ্ঞানালোক অভিজাত ও দার্শনিক। তিনি ১৭৯৬ সালে "ধারণার বিজ্ঞান" ("science of ideas") হিসেবে ফরাসী সন্ত্রাসের রাজত্ব বা রেইন অফ টেরর এর সময়ে এই শব্দটি নিয়ে আসেন, এবং এর মাধ্যমে তিনি জনতার অযৌক্তিক আবেগের বিরোধী হিসেবে ধারণার একটি যৌক্তিক ব্যবস্থার বিকাশ সাধনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সমসাময়িক দর্শনে "ভাবাদর্শ" শব্দটির অর্থ তার আগের সেই উৎপত্তিগত অর্থের চেয়ে সংকীর্ণ হয়ে গেছে, যেখানে ভাবাদর্শের সেই আগের বিস্তৃত ধারণাটি এখন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ওয়ার্ল্ডভিউ, দি ইমাজিনারি এবং সত্তাতত্ত্ব এর মত বিস্তৃত ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিভিন্ন দার্শনিক মত অনুসারে ভাবাদর্শ দ্বারা জনগণ, সরকার বা অন্যান্য গোষ্ঠীদের দ্বারা অনুসৃত আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায় যা জনসংখ্যার বেশিরভাগের দ্বারা সঠিক বল বিবেচিত হয়। আবার মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও সমালোচনাতত্ত্ব অনুসারে ভাবাদর্শ দ্বারা সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণী যেমন অভিযাতদের দ্বারা সমাজের সকল সদস্যের উপর আরোপিত ধারণার সমাহারকেও বোঝানো হয়। ফরাসী মার্ক্সীয় দার্শনিক লুইস আলথুজার এর সংজ্ঞায়, ভাবাদর্শ হচ্ছে "কোন কিছুর কাল্পনিক অস্তিত্ব (বা ধারণা) যেন তা অস্তিত্বের বাস্তব অবস্থাসমূহের সাথে সম্পর্কিত"।
"ভাবাদর্শ" শব্দটি ইংরেজি "ideology" এর পারিভাষিক শব্দ। "ideology" শব্দটির জন্ম হয় ফরাসী বিপ্লবের সময়কার সন্ত্রাসের রাজত্বের সময়, এবং সেই সময় এই শব্দে বিভিন্ন অর্থ ছিল। ১৭৯৬ সালে আঁতোয়া দেসতুত দে ট্রেসি (Antoine Destutt de Tracy) "ideology" শব্দটি এবং এর সাথে সম্পর্কিত ধারণাগুলোর প্রচলন করেন। সেই সময় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল এবং তিনি কারাগারে বিচারের অপেক্ষায় বন্দী ছিলেন। এই শব্দটি তৈরি হয়েছে গ্রীক idea (ধারণা) (লকীয় অর্থের কাছাকাছি) এবং -logy এর সমন্বয়ে। "ধারণাসমূহের বিজ্ঞান" বা "সায়েন্স অফ আইডিয়াস" অর্থে তিনি এই শব্দটি তৈরি করেন। তিনি আশা করেছিলেন এই ধারণাসমূহের বিজ্ঞান নৈতিক বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি নিরাপদ ভিত্তি তৈরি করবে। তিনি দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এই শব্দটি তৈরি করেন: (১) বস্তুজগতের সাথে মিথোস্ক্রিয়ার সময় ব্যক্তি যে অনুভূতি লাভ করেন, এবং (২) এইসব অনুভূতির জন্য মনে যেসব ধারণা জন্মায়। তিনি "ভাবাদর্শকে" একটি উদারনৈতিক দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন যা ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পত্তি, মুক্ত বাজার এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাকে রক্ষা করবে। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, এইসব দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবাদর্শ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সার্বিক শব্দ, কেননা ধারণাসমূহের বিজ্ঞানে সেগুলোর প্রকাশ ও প্রতিপাদন বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। যে বিদ্রোহের ফলে ম্যাক্সিমিলিয়েন দ্য রোবসপিয়ের ক্ষমতাচ্যুত হন, সেই বিদ্রোহের কারণেই ট্রেসি মুক্ত হয়ে তার এই কাজে মনোনিবেশ করেন।
নেপোলিয়নের রাজত্বের সময় ট্রেসি বিপ্লবের সন্ত্রাসবাদী দশার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করেন এবং তিনি জনতার অযৌক্তিক আবেগের বিরুদ্ধে একটি ধারণার একটি যৌক্তিক ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করেন। জনতার এই অযৌক্তিক আবেগের জন্যই তিনি মৃত্যুর মুখে পতিত হতে যাচ্ছিলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর কাছে "ভাবাদর্শ" শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করেন, তিনি এই শব্দটিকে ট্রেসির প্রতিষ্ঠানে তার উদারনীতিবাদী শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। কার্ল ম্যানহেইম এই "ভাবাদর্শ" শব্দটির অর্থের পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, নেপোলিয়ন তার বিরোধীদেরকে "দি আইডিওলগস" হিসেবে বর্ণনা করার পরেই এই শব্দটি তার আধুনিক অর্থ গ্রহণ করে। কার্ল মার্ক্স "ভাবাদর্শ" শব্দটির এই নেতিবাচক অর্থটিকেই গ্রহণ করেছেন, তার রচনাগুলোতে ব্যবহার করেছেন। তিনি ট্রেসিকে একজন "fischblütige Bourgeoisdoktrinär" বা মৎসরক্তীয় বুর্জোয়া নীতি হিসেবে বর্ণনা করেন।
মিশেল ফুকো তার ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ গ্রন্থে এই "আইডিওলগস" বা আদর্শিকদের সম্পর্কে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "আইডিওলগগণ" আলোকপ্রাপ্তি বিজ্ঞানের জন্য খুব প্রভাবশালী ছিলেন। "আইডিওলজি" শব্দটি এই "আইডিওলগগণই" তৈরি করেছেন। এই "আইডিওলগ" হচ্ছেন প্যারিসের একটি বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী যারা ধারণার বিজ্ঞান এর অন্তর্দৃষ্টি অন্বেষণ করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ভিত্তি প্রদান করতে চেয়েছিলেন। ফুকো তার ডিসকোর্স তত্ত্বের মাধ্যমে এই আইডিওলগদের লেখা সামাজিক, শিক্ষায়তনিক ও রাজনৈতিক রচনাগুলো থেকে তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। সেই সাথে তিনি এও জানতে চেয়েছেন যে তারা কীভাবে তাদের "ধারণার বিজ্ঞান" এর বিকাশ ঘটান। আইডিওলগদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যু ছিলেন কাবানিস, কনদরসে (Condorcet), সারভান, সে, মাদাম দে স্তায়েল এবং দেসতুত দে ট্রেসি। তারা তাদের এই "ধারণার বিজ্ঞানকে" ব্যবহার করে তদকালীন বোনাপার্ট এর লিবারাল রিপাবলিকানিজম বা উদারনৈতিক প্রজাতন্ত্রবাদের সমালোচনা করতেন।
ট্রেসির প্রধান গ্রন্থ দি এলিমেন্টস অফ আইডিওলজি খুব দ্রুত ইউরোপের প্রধান ভাষাগুলোতে অনুদিত হয়। এবং পরবর্তী প্রজন্মে যখন নেপলীয়নোত্তর সরকার প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থা গ্রহণ করে তখন তা ইতালীয়, স্পেনীয় এবং রুশ চিন্তাবিদদেরকে প্রভাবিত করে যারা তাদের নিজেদেরকে "উদারনীতিবাদী" হিসেবে বর্ণনা করতেন এবং ১৮২০ এর দশকের প্রথম দিকে পুনরায় বৈপ্লবিক কার্যাবলি শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে স্পেইনের কার্লিস্ট বিদ্রোহ, ফ্রান্স ও ইতালীর কারবোনারি সোসাইটিজ এবং রাশিয়ার দেসেম্ব্রিস্টরা উল্লেখযোগ্য। ট্রেসির সময়ের এক শতাব্দি পরও এই শব্দটি বারবার এই শব্দটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারণা গ্রহণ করতে থাকে।
(সম্ভবত ভাবাদর্শ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থের কাছাকাছি অর্থের সবচেয়ে বেশি প্রবেশযোগ্য সূত্রটি হচ্ছে হিপ্পোলিত তেইন এর Ancien Régime ("অরিজিনস অফ কনটেম্পোরারি ফ্রান্স" এর প্রথম খণ্ড) নিয়ে কাজগুলো। এখানে তিনি "ভাবাদর্শ" শব্দটিকে বরং সক্রেতীয় পদ্ধতিতে শিক্ষনের দর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এই ভাবাদর্শে সাধারণ পাঠক যে শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে ইতিমধ্যে জ্ঞাত তার সম্প্রসারণ নেই, এবং বাস্তব বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ থেকে উদাহরণের দরকার হয় সেগুলোও নেই। তাইন দেখান, এই ভাবাদর্শে কেবল দেসটুট দে ট্রেসি এর অবদানই নেই, বরং তিনি যাদের যাদের লেখা পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাদের অবদানও রয়েছে, যাদের মধ্যে একজন হচ্ছে কনডিলাক। কারাগারে থাকার সময় দেসটুট লক (Locke) ও কোঁদিয়াক (Condillac) এর লেখা পড়েছিলেন।
"ভাবাদর্শ" শব্দটি তার মর্যাদাহানিকর ভাব বা নেতিবাচকতা কিছু অংশকে ঝেড়ে ফেলেছে, এবং এখন শব্দটি সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করার জন্য নিরপেক্ষ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কার্ল মার্ক্স এই শব্দটিকে শ্রেণী সংগ্রাম ও আধিপত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু অন্যেরা এই শব্দটিকে কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ ও সামাজিক সংশক্তির একটি প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে দেখেন।
বিভিন্ন ভাবাদর্শের ধরন নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিশ্লেষণের সময়ে কেউ কেউ এই বিশ্লেষণকে মেটা-আইডিওলজি বলে অভিহিত করেছিলেন। এক্ষেত্রে এই মেটা-আইডিওলজি অর্থ হচ্ছে ভাবাদর্শ এর গঠন, আকার ও প্রকাশ নিয়ে পাঠ।
সাম্প্রতিক বিশ্লেষণগুলো ভাবাদর্শকে ধারণার সুসঙ্গত পদ্ধতি হিসেবে সমর্থন করে। এগুলো বাস্তবে কিছু মৌলিক পূর্বানুমানের উপর নির্ভর করে যেগুলোর কোন বাস্তবিক ভিত্তি থাকতেও পারে, নাও পারে। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের গ্রহণ করা বিষয়ীগত বা ব্যক্তিবাচক সিদ্ধান্ত বা পছন্দ থেকে ধারণাগুলো একটি সঙ্গতিপূর্ণ পৌনপুনিক প্যাটার্নে পরিণত হয়, বা একটি নির্দিষ্ট আকৃতি লাভ করে, আর এভাবেই ধারণাগুলো একটি ভাবাদর্শে পরিণত হয়। আর এই ভাবাদর্শের বীজকে ঘিরেই আরও নতুন নতুন ধারণা বা চিন্তাধারা তৈরি হতে থাকে। ভাবাদর্শে বিশ্বাসীগণ সেই ভাবাদর্শকে হালকাভাবেও বিশ্বাস করতে পারেন, আবার খুব সক্রিয় হয়েও তা গ্রহণ করে তার প্রচারমূলক কাজেও লেগে যেতে পারেন। সবচাইতে সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ভাবাদর্শগুলোকে সঠিক বা ভুলই হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
ম্যানফ্রেড স্টেগার এবং পল জেমসের সংজ্ঞায় এই প্যাটার্ন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ভাবাদর্শের গঠন, এবং সত্যের সাথে ভাবাদর্শের সম্পর্ক - উভয়ই উঠে আসে:
জর্জ ওয়ালফোর্ড এবং হ্যারল্ড ওয়াল্সবি সিস্টেমেটিক আইডিওলজি বা সুসম্বদ্ধ ভাবাদর্শ নামে নতুন একটি শব্দ তৈরি করেন, এখানে তারা ভাবাদর্শ ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যকার সম্পর্ককে খতিয়ে দেখতে চান। চার্লস ব্ল্যাটবার্গ রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্যসূচিত করার জন্য কাজ করেছেন।
"ভাবাদর্শ" শব্দটি ব্যবহৃত হয় ডেভিড ডব্লিউ মিনার এমন ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ দেখিয়েছেন:
উইলার্ড এ. মুলিন্সের মতে একটি ভাবাদর্শ ‘আনন্দলোক’ এবং ‘ঐতিহাসিক পৌরাণিক’ সংশ্লিষ্ট (কিন্তু বিভিন্ন) বিষয়ের সঙ্গে বিপরীত হবে। একটি ভাবাদর্শ চারটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত হয়:
টেরি এগলেটন (কম বা বেশি কোন বিশেষ আদেশ নয়) মতাদর্শের রূপরেখা দেখিয়ে কিছু সংজ্ঞা দেন:
জার্মান দার্শনিক খ্রিস্টান ডাঙ্কার একটি "ভাবাদর্শ ধারণার সমালোচনামূলক প্রতিফলনের" (২০০৬) জন্য আহবান করেন। তার কাজে, তিনি ভাবাদর্শের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন, সেইসাথে জ্ঞানতত্ত্ব ও ইতিহাসের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে সংযোগ দেখাতে ও প্রয়াস চালান। এই কাজে, ভাবাদর্শ শব্দটি উপস্থাপনার একটি পদ্ধতি হিসেবে যা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে পরম সত্য বলে দাবি করে এরূপ পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
যদিও "ভাবাদর্শ" শব্দটি প্রায়শই রাজনৈতিক আলোচনায় পাওয়া যায়, তবে ভাবাদর্শের বিভিন্ন ধরন রয়েছেঃ রাজনৈতিক, সামাজিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক ইত্যাদি।
সমাজের মার্কসবাদী অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং উপরিকাঠামো মডেলে ‘ভিত্তি’ দ্বারা উৎপাদনের সম্পর্ক এবং উৎপাদনের উপায়গুলি নির্দেশ করে, এবং ‘উপরিকাঠামো’ দ্বারা প্রভাবশালী ভাবাদর্শ (ধর্মীয়, আইনগত, রাজনৈতিক ব্যবস্থা) উল্লেখ করে। উৎপাদনের অর্থনৈতিক ভিত্তি একটি সমাজের রাজনৈতিক উপরিকাঠামো নির্ধারণ করে।
শাসকশ্রেণীর-আগ্রহ উপরিকাঠামো এবং ভাবাদর্শের প্রকৃতি নির্ধারণ করে— কর্মকাণ্ডসমূহ সম্ভবপর হয় কারণ শাসকশ্রেণী উত্পাদনের মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদনের একটি সামন্ত্রতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, ধর্মীয় ভাবাদর্শ হচ্ছে উপরিকাঠামোর সবচেয়ে বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, মার্কসবাদী ও উপরিকাঠামোর অর্থনৈতিক বেস. যখন পুঁজিবাদী গঠনে, ভাবাদর্শসমূহ যেমন উদারনীতি এবং সামাজিক গণতন্ত্র কর্তৃত্ব করে। সুতরাং একটি সমাজের সততা প্রতিপাদনে ভাবাদর্শের গুরুত্ব অসীম; এটা রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত চেতনার মাধ্যমে সমাজের বিচ্ছিন্ন দলসমূহকে বিভ্রান্ত করে।
কিছু ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। গোর্গি লুকাস শাসকশ্রেণীর শ্রেণী-চেতনার একটি অভিক্ষেপ হিসেবে ভাবাদর্শকে পেশ করেন। আন্তোনিও গ্র্যামস্কি সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব ব্যবহার করে ব্যাখ্যা দেন কেন শ্রমিকশ্রেণীর তাদের কি এমন বৃহৎ স্বার্থে একটি ভ্রান্ত ভাবাদর্শের ধারণা থাকে। মার্কস যুক্তি দেখান যে, "যেসব শ্রেণীর তাদের নিষ্পত্তির জন্য বস্তুগত উৎপাদনের মাধ্যম রয়েছে, মানসিক উৎপাদনের ব্যাপারেও তাদের একই সময়ে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।"
মার্কসবাদী বর্ণনায় "ভাবাদর্শ সামাজিক প্রজননের একটি উপকরণ স্বরূপ" যা সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানে ধারণাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- কার্ল ম্যানহেম, ড্যানিয়েল বেল এবং জুরগেন হ্যাবারমাস প্রমুখের ধারণা। তাছাড়া, ম্যানহেম, সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বরডিও দ্বারা বিকশিত একটি ধারণা, সকল ভাবাদর্শ(মার্কসবাদ সহ) সামাজিক জীবন থেকে প্রসূত, এটাকে গ্রহণ করে "মোট" কিন্তু "বিশেষ" ভাবাদর্শ মার্কসবাদী ধারণা থেকে একটি "সাধারণ" এবং "মোট" ভাবাদর্শগত ধারণা বলে অগ্রসর এবং বিকশিত করেন। স্লাভোয় জিজেক এবং আগেকার ফ্রাংকফুর্ট স্কুল ভাবাদর্শের ‘সাধারণ তত্ত্ব’ থেকে একটি মনঃসমীক্ষার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বলে যে ভাবাদর্শ শুধুমাত্র সচেতন ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেনা, অচেতন ধারণাও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।
লুই আলথুসার ভাবাদর্শের আধ্যাত্মিক এবং বস্তুবাদী উভয় ধারণা প্রস্তাব করেন, যা আলোচনা বা বক্তৃতায় একটি বিশেষ ধরনের ব্যবহার করায়। প্রস্তাবের একটি সংখ্যা, যা কখনো অসত্য নয়, যেগুলো অন্যান্য সংখ্যক প্রস্তাবনার সুপারিশ করে। এই ভাবে, ফাঁকা আলোচনার সারমর্ম বুঝিয়ে থাকে যেগুলো বলা হয়নি(তবে পরামর্শ দেওয়া হয়)।
উদাহরণস্বরূপ, বিবৃতিমতে "আইনের দৃষ্টিতে সকল সমান", যা বর্তমান আইনি ব্যবস্থার একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি, এটা প্রস্তাব দেয় যে সব মানুষের সমান মূল্য হতে পারে অথবা সমান "সুযোগ" থাকতে পারে। এটা সত্য নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধারণার জন্য এবং উৎপাদন মাধ্যমে ক্ষমতার ফলশ্রুতিতে কিছু লোক অন্যদের তুলনায় বেশি (অত্যধিক) পেতে সক্ষম হচ্ছে। ক্ষমতার এইরূপ অসমতা সবধরনের শরীকানার উভয় ব্যবহারিক মূল্য এবং ভবিষ্যত সুযোগ সমানভাবে যে দাবি করে তার বিপরীত হয়; উদাহরণস্বরূপ, ধনীরা উত্তম আইনি প্রতিনিধিত্ব পেতে সক্ষম হয়, যা বাস্তবিকভাবে তাদের আইনের দৃষ্টিতে বিশেষাধিকার দিয়ে থাকে।
এছাড়াও আলথুসার তার ভাবাদর্শ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে আদর্শিক অবস্থা যন্ত্র ধারণা উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধ ছিল "ভাবাদর্শের কোন ইতিহাস নেই": যখন ব্যক্তিগত ভাবাদর্শের ইতিহাস রয়েছে, সমাজের সংগ্রামী সাধারণ শ্রেণীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী বিরতিতে আছে, ভাবাদর্শের সাধারণ রূপ হচ্ছে ইতিহাস বহির্ভূত।
আলথুসারের মতে, বিশ্বাস ও ধারণা হচ্ছে সামাজিক চর্চার ফলাফল, এর বিপরীত নয়। তাঁর প্রবন্ধে যাতে "ধারণা হচ্ছে বস্তুগত" অবিশ্বাসীদের দিকে প্যাসকেলের "মানহানিকর পরামর্শ" দ্বারা চিত্রিত করা হয়: "হাঁটু গেড়ে বস এবং প্রার্থনা কর, তবেই তোমার বিশ্বাস হবে"। আলথুসারের জন্য যা ভাবাদর্শগত তা একক ব্যক্তি-মানুষের সচেতন মনের বিষয়গত বিশ্বাস নাও হতে পারে, বরং আলোচনাসমূহ যা এই বিশ্বাস স্থাপন করে, বস্তুগত প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মানুষ্ঠানের দ্বারা লোকজন সচেতন নিরীক্ষণ এবং সমালোচনামূলক চিন্তাধারা না করেও গ্রহণ করে।
ফরাসি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক গায় ডীবর্ড, সিচুয়েশনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য, যুক্তি দেখান যে, পণ্য যখন সমাজের "অপরিহার্য বিভাগ" হয়, অর্থাৎ যখন পণ্যপ্রথা প্রক্রিয়ায় একে পুরাদস্তুরভাবে শেষ করা হয়, তখন সমাজের চিত্র পণ্য দ্বারা প্রচারিত হয় (জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেরূপ বর্ণনা করা হয় তাতে ধারণা এবং বস্তু শুধুমাত্র বিনিময় মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসাযোগ্য পণ্যদ্রব্য হিসাবে তাদের আহরিত মান দ্বারা গঠিত), যা জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং একটি নিছক উপস্থাপনায় সমাজকে হ্রাস করে।
জার্মান সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ সিলভিও ভিয়েটা উন্নয়ন এবং প্রাচীনকাল থেকে অগ্রগামী পশ্চিমা যৌক্তিকতার সম্প্রসারণকে প্রায় ভাবাদর্শের দ্বারা অনুষঙ্গী এবং এর দ্বারা আকৃতিপ্রাপ্ত বলে বর্ণনা করেন, যা "ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ", "সত্য ধর্ম", বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, বা সাম্যবাদে, পৃথিবীতে স্বর্গের একটি ধরন হিসাবে ভবিষ্যত ইতিহাসের দৃষ্টির মত। তিনি বলেন যে এসবের মত ধারণাসমূহ, আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক কর্মের দ্বারা একটি আদর্শবাদী ব্যহ্যাবরণে পরিণত হয় এবং তাদের নেতাদের একটি উচ্চতর এবং "রাজনৈতিক ধর্মে" (এরিক ভেজেলিন), সজ্জিত করে, যা প্রায় ঈশ্বরের মত ক্ষমতাদর, যাতে তারা লাখ লাখ মানুষের জীবনের (এবং মৃত্যুর) উপর প্রভুত্ব করতে পারে। সুতরাং তিনি বিবেচনা করেন যে ভাবাদর্শের এইসব ধারণা, যার তলদেশে তারা আদর্শবাদকে প্রকাশিত হিসেবে কাজ করতে পারে, যেটি অযৌক্তিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতায় ঢালের মতো অবদান রাখে।
সমাজবিদ্যায়, একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হচ্ছে আদর্শের একটি নির্দিষ্ট নৈতিক সমষ্টি, নীতি, মতবাদ, পৌরাণিক কথা, অথবা একটি সামাজিক আন্দোলন, প্রতিষ্ঠান, শ্রেণী বা বৃহৎ সম্প্রদায়ের একটি প্রতীক, যা ব্যাখ্যা করে কীভাবে সমাজের কাজ করা উচিত, এবং একটি নির্দিষ্ট সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে কিছু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিচিত্র প্রস্তাব করে। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ একটি সমাজের বিভিন্ন দিক, (উদাহরণস্বরূপ): অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শ্রম আইন, ফৌজদারি আইন, বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক কল্যাণের বিধান, বাণিজ্য, পরিবেশ, গৌণ আইন, অভিবাসন, জাতি, সামরিক, দেশপ্রেমের ব্যবহার, এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মসহ অন্তর্ভুক্ত।
রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দুইটি মাত্রা আছে:
রাজনৈতিক ভাবাদর্শ শ্রেণিবিন্যাসের জন্য অনেক প্রস্তাবিত পদ্ধতি আছে, এই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির প্রতিটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বর্ণালী উৎপন্ন করে।
ভাবাদর্শ রাজনৈতিক বর্ণালীতে তাদের অবস্থান দ্বারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করে,(যেমন বামপন্থী, কেন্দ্রপন্থী বা ডানপন্থী হিসাবে) যদিও এ ব্যাপারে স্পষ্টতা প্রায়শই বিতর্কিত হতে পারে। অবশেষে, ভাবাদর্শ রাজনৈতিক কৌশল (উদাঃ জনসংখ্যাবাদ) থেকে এবং একক বিষয় থেকে পৃথক হতে পারে যে একটি দল তৈরি করা যেতে পারে (উদাঃ মারিজুয়ানার রাজনৈতিক দল)। দার্শনিক মাইকেল ওকেশুট ভাবাদর্শের একটি ভাল সংজ্ঞা প্রদান করেন যে "ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত যৌক্তিক সত্যের অনুমিত উপ-স্তর নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংক্ষিপ্তকরণ" হিসেবে।
একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শে মূলত নিজেই কীভাবে ক্ষমতা বরাদ্দের সঙ্গে যুক্ত এবং কিসে ক্ষমতা শেষ হয়, ব্যবহার করা উচিত। কিছু দল খুব ঘনিষ্ঠভাবে একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শ অনুসরণ করে, অন্যগুলি বিশেষভাবে সেগুলোর যে কোনো একটিকে গ্রহণ না করে সংশ্লিষ্ট ভাবাদর্শের একটি গোষ্ঠী থেকে বিস্তৃত অনুপ্রেরণা নিতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কিছু নির্দিষ্ট ধারণাসমূহ রয়েছে যার জন্য এটাকে উত্তম সরকার গঠন বিবেচনা করা হয় (উদাঃ গণতন্ত্র, জননেতৃত্ব, ধর্মশাসন, খিলাফত ইত্যাদি), এবং শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (উদাঃ পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ইত্যাদি)। কখনও কখনও একই শব্দ একটি ভাবাদর্শ ও তার প্রধান ধারণা উভয়টিকে শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, "সমাজতন্ত্র" একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে উল্লেখ করতে পারে, বা এটা একটি ভাবাদর্শকে উল্লেখ করতে পারে যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমর্থন করে।
ভাবাদর্শ ধারণার গবেষণাসমূহকে নিজেই (নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের বদলে) নিয়মানুগ ভাবাদর্শের নামে চালানো হয়েছে।
১৯৯১ পরবর্তী সময়ে, অনেক মন্তব্যকারীরা দাবী করেন যে আমরা একটি মতাদর্শিক-উত্তর যুগে বাস করছি, যার পুনরুদ্ধারে, সর্ব-পরিবেষ্টনী ভাবাদর্শসমূহ ব্যর্থ হয়েছে, এবং এই দৃশ্য প্রায়ই যুক্ত করা হয় ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার লেখা ‘‘ইতিহাসের প্রান্তে’’ বইয়ে। অপরপক্ষে, নিয়েনহয়সার পর্যবেক্ষণ করেন তার গবেষণা (মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে) "উৎপাদিত ভাবাদর্শকে" চলমান হিসেবে।
স্লাভোয় জিজেক উল্লেখ করেছেন কীভাবে ভাবাদর্শ-উত্তর ধারণাসমূহ ভাবাদর্শের গভীরতম, অস্পষ্টতমতাকে সক্রিয় করতে পারে। ভ্রান্ত চেতনা বা মিথ্যা অসূয়ার একটি ধরন, যা কারো বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ হওয়ার সাপেক্ষে নিয়োজিত হয়ে, নিরপেক্ষ অসূয়ার ভান করে, বাস্তবে যদিও এসব তা নয়।
ভাবাদর্শ এড়ানোর সাহায্যের চেয়ে বরং, এই ভ্রষ্টতা শুধুমাত্র একটি বিদ্যমান প্রতিশ্রুতিকে গভীর করে। জিজেক এটাকে "আধুনিকতা-উত্তরবাদী ফাঁদ" বলে অভিহিত করেন, পিটার স্লটারডিক ইতিমধ্যে একই ধারণা ১৯৮৮ সালে বিকশিত করেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ পরিবারের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয় থাকে।
যখন একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ একটি সরকার ব্যবস্থার মধ্যে প্রাধান্য দিয়ে একটি পরিব্যাপক উপাদান হয়, তখন এটিকে ভাবাদর্শবাদ বলা যায়।
সরকারের বিভিন্ন গঠনে ভাবাদর্শকে বিভিন্ন উপায়ে কাজে লাগানো হয়, যা সবসময় রাজনীতি ও সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নির্দিষ্ট কিছু ধারণা ও চিন্তাধারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বা বাতিল বলে গণ্য হয়েছে, অন্যদের দ্বারা, যেগুলো তাদের উপযুক্ততার উপর নির্ভর করে বা কতৃত্বকারী সমাজশৃঙ্খলার জন্য ব্যবহার করে।
এমনকি, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে, যখন বিদ্যমান বিশ্বাসের চ্যালেঞ্জসমূহ উত্সাহ দেয়, তখন প্রভাবশালী দৃষ্টান্ত বা মানসিকতা- নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ, তত্ত্ব, বা পরীক্ষাকে অগ্রসর হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পারে। ভাবাদর্শ হিসেবে গৃহীত, বিজ্ঞানের একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে বাস্তুসংস্থান, যা পৃথিবীতে জীবন্ত বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অধ্যয়ন করে। ইন্দ্রিয়লব্ধ মনোবৈজ্ঞানিক জেমস জে গিবসন বিশ্বাস করতেন যে পরিবেশগত সম্পর্কে মনুষ্য-উপলব্ধি আত্ম সচেতনতা এবং চেতনার স্বীয় ভিত্তি ছিল। ভাষাবিদ জর্জ লেকফ গণিতের একটি জ্ঞান-সম্পর্কীয় বিজ্ঞানকে প্রস্তাব করেছেন যেটাতে পাটীগণিতের সবচেয়ে মৌলিক ধারণাকে মনুষ্য-উপলব্ধি হিসেবে দেখা হবে, যা নিজেই একটি বাস্তুসংস্থানের মধ্যে প্রসূত।
নিগূঢ় বাস্তুসংস্থান এবং আধুনিক বাস্তব্যবিদ্যা আন্দোলন (এবং, একটি ক্ষুদ্রতর মাত্রায়, সবুজ দল) একটি ইতিবাচক ভাবাদর্শ হিসেবে পরিবেশগত বিজ্ঞান রূপে গৃহীত হয়েছে বলে মনে হয়।
কেউ কেউ একইভাবে পরিবেশগত অর্থনীতির প্রতি অপবাদ আরোপ করেন যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। সবুজ অর্থনীতির আধুনিক অনুশীলন উভয় পন্থার সংযোগ ঘটায় এবং বিজ্ঞানের অংশ, ভাবাদর্শের অংশ মনে করা হয়।
ভাবাদর্শের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে শুধুমাত্র অর্থনীতির তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন— কিছু উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ভিত্তিক ভাবাদর্শে নব্যউদারনীতিবাদ, অর্থ-কেন্দ্রিকতাবাদ, বানিজ্যবাদ, মিশ্র অর্থনীতি, সামাজিক ডারউইনবাদ, সাম্যবাদ, অবাধনীতি অর্থনীতি, এবং মুক্ত বাণিজ্য অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও নিরাপদ বাণিজ্য এবং ন্যায্য বাণিজ্যের বর্তমান তত্ত্ব রয়েছে যা ভাবাদর্শ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা ক্রমবর্ধমানভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ভাবাদর্শসমূহ প্রতিফলিত করে (অসচেতন) প্রেরণাদায়ী পদ্ধতিকে, যেরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক প্রত্যয় সবসময় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তাকে উল্টোদিকে প্রতিফলিত করে। জস্ট, লেগারউড এবং হারডিন ২০০৮ সালে যে ব্যাখ্যার গুচ্ছ-পূর্ব একক হিসেবে ভাবাদর্শ কাজ করতে পারে বলে প্রস্তাব দেন, যার কারণে বিশ্বকে বুঝতে মৌলিক মানবিক-উদ্দেশ্য বিস্তার করে অস্তিত্বের হুমকি এড়ানো, এবং মূল্যবান আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। এই লেখকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এধরনের উদ্দেশ্য, ক্রম-সমর্থন বৈশ্বিকদৃষ্টিভঙ্গিকে সামঞ্জস্যহীনভাবে চালিত করতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা সাধারণত খুঁজে পান যে ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট, পৃথক পার্থক্য পরিবর্তনশীল, আবশ্যক, এবং আদর্শিক বিশ্বাসের একটি সাধারণ যোগসূত্র আছে বলে মনে করেন।
প্রেক্ষাপটবিদ বব হজের মতে, ভাবাদর্শ "একটি ঐকিক বস্তুকে চিহ্নিত করে যা সামাজিক প্রতিনিধি এবং পদ্ধতির সাথে জটিল অর্থগুচ্ছকে একীভূত করে, যা তাদেরকে উৎপন্ন করে থাকে। অন্য কোন শব্দ এমনকি 'ভাবাদর্শ' ও এই বস্তু ধারণ করে না। ফুকোর 'এপিস্টেম' খুবই সংকীর্ণ এবং বিমূর্ত, যা যথেষ্ট সামাজিক নয়। তার 'আলোচনা', জনপ্রিয় কারণ এটি কিছু ভাবাদর্শ ভূখণ্ডের সঙ্গে কম অবান্তর অতিক্রম করে, খুব মৌখিক পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ হয়। 'বৈশ্বিকদৃষ্টিভঙ্গি' এতোই অধ্যাত্মিক থাকে যে, 'প্রজ্ঞাপন' খুব বোঝাই করা হয়। দ্বন্দ্বগুলো সত্ত্বেও অথবা কারণে 'ভাবাদর্শ' এখনও সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাইকেল ফ্রীডেনের মতো লেখকেরা সম্প্রতি ভাবাদর্শ অধ্যয়নে একটি শব্দার্থিক বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
Owlapps.net - since 2012 - Les chouettes applications du hibou