Aller au contenu principal

ইসলামে রাজনীতি


ইসলামে রাজনীতি


ইসলামে রাজনীতি (সিয়াসাতুশ শরিয়াহ) মূলত কোরআন, সুন্নাহ (ইসলামী নবী মুহাম্মদের বানী ও জীবনাচরণ), ইসলামের ইতিহাস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম থেকে উদ্ভূত। ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামে রাজনৈতিক ধারণাসমূহের মধ্যে নির্বাচিত নেতৃত্ব একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুহাম্মদের এর পর যারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় নেতৃত্বদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরকে খলিফা বলা হয়। ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তায় রাষ্ট্র পলিচালনার জন্য ইসলামি আইন বা শরিয়াহ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শরিয়া আইন অনুসারে নির্বাচিত শাসকবৃন্দ জনগণের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে শুরা বা পরামর্শ সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। রাশিদুন খলিফাসহ প্রাথমিক খলিফাদের পর দ্বিতীয় মুয়াবিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম রাজা বাদশাহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বা বিজিত অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আধুনিককালে বিভিন্ন আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচলনের ব্যাপকতার কারণে সেগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন অঞ্চলসমূহে ইসলামের প্রভাবে ও সংমিশ্রণে বিভিন্ন মাত্রার মিশ্র রূপ লাভ করেছে। ইসলামী আলেমগণ একমাত্র প্রথমত খেলাফত ও দ্বিতীয়ত মুসলিম রাজতন্ত্রকে ইসলামী বৈধ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে দাবি করেন এবং বাকি রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোকে হারাম বললেও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমদের ক্ষমতায় যাবার পথ হিসেবে সেগুলো ব্যবহার করাকে বৈধ বলে রায় দেন।

১৯২৪ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বিবেচ্য বিষয় ছিলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করা। ছয় দিনের যুদ্ধে আরব বাহিনীর পরাজয়, স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ইত্যাদি রাজনৈতিক ঘটনাবলি ইসলামী আন্দোলন সংগ্রামের আবেদনকে বেগবান করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাস্বরূপ মুসলিম বিশ্বের ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

শব্দতত্ত্ব ও সংজ্ঞা

আরবি ভাষায় নীতি ও রাজনীতি উভয়কে বোঝাতেই সিয়াসাত বা সিয়াসাহ (سياسة) শব্দটি ব্যবহৃত হয়, ব্যকরণবিদদের মতে, এটি আরবি ধাতু সাসা (ساس) থেকে এসেছে যার অর্থ পরিচালনা করা, ব্যবস্থাপনা করা, শাসন করা। শব্দটির ফিল মুদারী বা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ক্রিয়ারূপ হল ইয়াসুস (يسوس)। ইসলামিক স্কলারদের মতে, ইসলামে ও আরবি ভাষায় সিয়াসাহ শব্দটি দ্বারা প্রচলিত রাজনীতি, ক্ষমতা ও নেতৃত্বকে বোঝায় না, বরঞ্চ এর দ্বারা কোন অবস্থার উন্নয়ন, উদ্ভূত সমস্যার সমাধানকরণ, পরিস্থিতির উন্নতিকরণ, কোন কিছুকে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় নিয়ে আসা ইত্যাদিকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ তিনি নবী সুলায়মানের একটি ঘটনাকে উদ্ধৃত করেন, যেখানে একটি শিশুর দুইজন মাতৃত্বের দাবিদারের মধ্য হতে যে কৌশলের মাধ্যমে নবী সুলায়মান প্রকৃত মাকে চিহ্নিত করেন তাকে সিয়াসাত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, যে সকল বিষয়ে কোরআন ও সুন্নাহে উল্লেখিত শরিয়তের অকাট্য দলিল রয়েছে, সেসব বিষয়ে সিয়াসাহ বা নবউদ্ভাবিত সমাধান কৌশল বৈধ হবে না, একমাত্র শরিয়তে অনুল্লেখিত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রেই সিয়াসাহ-র প্রয়োগ বৈধ্য হবে।

প্রাথমিক গ্রন্থপঞ্জি

ইসলামী রাজনীতি বিষয়ক সর্বপ্রাচীন মৌলিক গ্রন্থ হলো আল-মাওয়ার্দীর আহকামুস সুলতানিয়াত (প্রশাসনিক বিধিমালা)। এছাড়াও পরবর্তী রচনাগুলার মধ্যে রয়েছে আবু ইয়ালার আহকামুস সুলতানিয়া, আবুল মায়ালি আল জুয়াইনির আল-গিয়াসি এবং ইবনে তাইমিয়ার সিয়াসাতুশ শারিয়াহ ইত্যাদি।

ধর্মগ্রন্থীয় পাণ্ডুলিপি

কুরআন

কুরআনে ইসলামি রাজনীতি প্রসঙ্গ রাজনৈতিক ইসলামপন্থীগণ সবচেয়ে বেশি ইকামতে দ্বীন নামক ধারণাটিকে তুলে ধরেন, যা সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে উল্লেখ আছে।

তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম (اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ) করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।

তবে এখানে আয়াতটিতে দ্বীন কায়েম অংশে দ্বীন বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থীগণ এর দ্বারা আল্লাহর হুকুমত বা আল্লাহর আদেশ প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা তথা ইসলামী বা মুসলিম রাজনীতি বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা বোঝানো হয়েছে বলে দাবি করেন, অপরদিকে মূলধারার সালাফী মতাবলম্বীগণ এর দ্বারা তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার কথা বোঝানো হয়েছে বলে দাবি করে থাকেন, এবং প্রথোমক্ত হুকুমত কায়েম সংক্রান্ত ব্যাখ্যাকে ভুল দাবি করে তার বিরোধিতা করেন।

ইসলামে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের আনুগত্যের প্রসঙ্গে সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতকে উল্লেখ করা হয় যাকে আনুগত্যের আয়াত বলা হয়েছে, এতে আল্লাহ ও ইসলামী নবী মুহাম্মদের পাশাপাশি উলিল-আমর বা দায়িত্বে নিয়োজিত ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের (শাসক ও ওলামা) আনুগত্য করতে বলা হয়েছে, যে আনুগত্য হল বৈধ ইসলামী নির্দেশসমূহের (হালাল) ব্যাপারে আনুগত্য, অনৈসলামিক নির্দেশের (হারাম) ব্যাপারে নয়।

হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের (উলীল আমরি মিনকুম), অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের অভিমত

মাইকেল কুক তার মুহাম্মদ নামক বইতে মন্তব্য করেন যে, যদিও কুরআন রাজনীতি নিয়ে কোন কথা বলেনি, তবে এতে নিপীড়িতদের (মুস্তাদ'আফীন), দেশত্যাগ (হিজরত), মুসলিম সম্প্রদায় (উম্মাহ) এবং আল্লাহর পথে লড়াই করার (জিহাদ) ধারণার উল্লেখ রয়েছে, যার রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে (যেমন কুরআন ৪: ৯৮) মুস্তাদ'আফিন ("দুর্বল বলে বিবেচিত", "সম্বলহীন" বা "নিপীড়িত") সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যেমন: কীভাবে ফেরাউনের মত লোকেরা তাদেরকে শোষণ করে, আল্লাহ কীভাবে তাদের সাথে ন্যায়বিচার করা হোক বলে আশা করেন এবং তারা যে দেশ থেকে অত্যাচারিত হয় সেখান থেকে কীভাবে তারা দেশত্যাগ করতে পারে (কুরআন ৪: ৯৯)। নবী ইব্রাহীম "আপন পালনকর্তার উদ্যেশ্যে দেশত্যাগ" করেছিলেন (কুরআন ২৯: ২৬)। কুরআনে অবিশ্বাসীদের (কুফফার) বিরুদ্ধে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং ঐশী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যদিও (কিছু) আয়াতে বলেছে যে এই আদেশটি হয়তবা তখনকার জন্য যখন অবিশ্বাসীরা যুদ্ধ শুরু করে এবং চুক্তি ও সমঝোতা করে তখন যুদ্ধের অবসান ঘটানো যেতে পারে। এছাড়াও কুরআনে বিজয়ীদের মাঝে যুদ্ধলব্দ সামগ্রীর যথাযথ বিভাজনের জন্যও কিছু আয়াত রয়েছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শত্রু বা "প্রতারকদের" "( মুনাফিকুন ) বিরুদ্ধে যুদ্ধেরও আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিছু আদেশ নবীর জীবদ্দশার পরবর্তীতে আর বিস্তৃত হয়নি, যেমন আল্লাহ ও তার নবীর সঙ্গে ঝগড়া করা বা নবীকে কথা বলার সময় তার সঙ্গে চিৎকার করে বা উঁচু গলায় কথা বলা। ইসলামের রাজনৈতিক শিক্ষা সীমিত হওয়ার কারণ হল, কুরআনে "কোন আনুষ্ঠানিক ও অব্যাহত কর্তৃত্বের কাঠামো"র ব্যপারে উল্লেখ করা হয়নি, এতে কেবল নবীকে মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আর এর মূলভাবের রাজনৈতিক ব্যবহার ছিল সে সময় অত্যন্ত সীমিত যখন কিনা বিভিন্ন শহর আর দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক বিস্তৃত কৃষক-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনাই যে ইসলামের সাফল্য হতে পারে তা মরুভূমির যাযাবর মানুষের ধারণাতীত ছিল।

হাদীস

রাজনীতি বা সিয়াসাত শব্দের উল্লেখ

বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে সিয়াসাত শব্দটির ধাতুমূল ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “বনি ইসরাইল নবীদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল (তাসুসুহুম আল-আম্বিয়া); প্রতিবার একজন নবী মারা গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হতেন আরেকজন নবী।

ইমাম নববী বলেন: "[তারা] নবীদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল" এর অর্থ হল নবীরা তাদের বিষয়গুলি দেখভাল করতেন শাসকদের মতো যারা জনগণের দায়িত্বে থাকেন। এইভাবে সিয়াসাহ বলতে বোঝায় এমনভাবে কোনো কিছুর যত্ন নেওয়া যা এর মঙ্গল বজায় রাখে এবং এর স্বার্থ পূরণ করে।

নেতৃত্বের নির্দেশনা

নেতৃত্বের প্রাথমিক শর্তঃ তিনজনের জামাআত ও কুরআনে (ইসলামী জ্ঞানে) পারদর্শিতা

সালিহ আল মুনাজ্জিদ তার হুব্বুস সিয়াসাত (নেতৃত্বপ্রীতি) বইতে বলেন, সুন্নাহ অনুযায়ী মানুষ সংঘবদ্ধ থাকলে একজন নেতা থাকা আবশ্যক।

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তিন ব্যক্তি একত্রে সফর কলে তারা যেন নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমীর বা নেতা বানায়।

আরেক হাদীসে এসেছে তিনজনের বেশি একত্রে থাকলে নেতা একজনকে বানাতে হবে আর এমন কাওকে বানাতে হবে যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কুরআন(ও সহীহ হাদীস তথা বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান) জানে।

কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ..... আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তিনজন লোক একত্রিত হলে তাদের একজনকে তাদের ইমাম বা নেতা হতে হবে। আর তাদের মধ্যে ইমামাত বা নেতৃত্বের সবচাইতে বেশী হাক্বদার সেই ব্যক্তি যে সবচেয়ে বেশী পড়েছে (أَقْرَؤُهُمْ, আক্বরাউহুম, এর ব্যাখ্যা হল যে কুরআন মাজীদ (ও সহীহ হাদীস তথা বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান) সবচেয়ে বেশি অধ্যয়ন করেছে)।

আরেক হাদীসে নেতা বা ইমাম বানানোর বিস্তৃত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। (অধিকাংশ আলেমের মতে এটি ধর্মীয় ইমামতি বা ধর্মীয় নেতৃত্ব, তবে অনেক আলেম একে রাজনৈতিক ইমামতি বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনের নির্দেশনা হিসেবেও সাব্যস্ত করেছেন।)

আবূ মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ জাতির ইমামতি এমন লোক করবেন, যিনি আল্লাহর কিতাব সবচেয়ে উত্তম পড়তে পারেন। উপস্থিতদের মাঝে যদি সকলেই উত্তম ক্বারী হন তাহলে ইমামতি করবেন ঐ লোক যিনি সুন্নাতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন। যদি সুন্নাতের ব্যাপারে সকলে সমপর্যায়ের জ্ঞানী হন তবে যে সবার আগে হিজরত করেছেন। হিজরত করায়ও যদি সবাই এক সমান হন। তাহলে ইমামাত করবেন যিনি বয়সে সকলের চেয়ে বড়। আর কোন লোক অন্য লোকের ক্ষমতাসীন এলাকায় গিয়ে ইমামতি করবে না এবং কেউ কোন বাড়ী গিয়ে যেন অনুমতি ছাড়া বাড়ীওয়ালার আসনে না বসে। (মুসলিম; তাঁর অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘‘আর কোন লোক অন্য লোকের গৃহে গিয়ে [অনুমতি ব্যতীত] ইমামতি করবে না।’)

জ্ঞানার্জন

হাদীসে আলিম ব্যক্তিকে নেতা বানাতে বলা হয়েছে এবং জাহেল ব্যক্তিকে নেতা বানানো কেয়ামতের লক্ষণ হিসেবে বলা হয়েছে।

৬৬৮৯-(১৩/২৬৭৩) কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ..... উরওয়াহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন যে, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মানুষের হৃদয় হতে ইলম ছিনিয়ে নেবেন না। তবে তিনি ‘আলিম সম্প্রদায়কে কবয করে ইলম উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন একজন আলিমও থাকবে না তখন মানুষেরা মূৰ্খ মানুষদেরকে নেতা বানিয়ে নিবে। মানুষ তাদের নিকট সমাধান চাইবে, এরপর তারা না জেনে ফাতাওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ হবে এবং মানুষদেরও গুমরাহ করবে।

সাহাবী ওমর ও সালফে সালেহীনগণ নেতা হওয়ার আগে ও পরে জ্ঞান অর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন।

উমর (রাঃ) বলেন, তোমরা নেতৃত্ব লাভের আগেই জ্ঞান হাসিল করে নাও। আবূ আবদুল্লাহ্ (বুখারী) বলেন, আর নেতা বানিয়ে দেওয়ার পরও, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ বয়োবৃদ্ধকালেও ইলম শিক্ষা করেছেন। হুমায়দী (রহঃ) ... আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেবলমাত্র দু’টি ব্যাপারই ঈর্ষা করা যায়; (১) সে ব্যাক্তির উপর, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা সম্পদ দিয়েছেন, এরপর তাকে হক পথে অকাতরে ব্যয় করার ক্ষমতা দেন; (২) সে ব্যাক্তির উপর, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা হিকমত দান করেছেন, এরপর সে তার সাহায্যে ফায়সালা করে ও তা শিক্ষা দেয়।

তবে নিজের জ্ঞান দ্বারা নেতৃত্ব জাহিরের উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করাকে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে।

কাব ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যে লোক আলিমদের সাথে তর্ক বাহাস করা অথবা জাহিল-মূর্খদের সাথে বাকবিতণ্ডা করার জন্য এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশে ইলম অধ্যয়ন করেছে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

সততা ও নির্লোভতা

ব্যক্তিগত জীবনে সৎ এবং নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে মন থেকে অপছন্দকারী লোকদেরকে নেতৃত্বের যোগ্য হিসেবে হাদীসে বলা হয়েছে।

আবূল ইয়ামান (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না তোমাদের যুদ্ধ হবে এমন এক জাতির সঙ্গে যাদের পায়ের জুতা হবে পশমের এবং যতক্ষণ না তোমাদের যুদ্ধ হবে তুর্কিদের সহিত যাদের চক্ষু ক্ষুদ্রাকৃতি, নাক চ্যাপ্টা, চেহারা লাল বর্ণ যেন তাদের চেহারা পেটানো ঢাল। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ হবে যারা নেতৃত্বে ও শাসন ক্ষমতায় জড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত একে অত্যন্ত ঘৃণা ও অপছন্দ করবে। মানুষ/মানব সমাজ খনির ন্যায় (এতে ভালো মন্দ সবই আছে) যারা জাহিলিয়াতের যুগে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম, ইসলাম গ্রহণের পরও তাঁরা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। তোমাদের নিকট এমন যুগ আসবে যখন তোমাদের পরিবার-পরিজনরা, ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়ার চাইতেও আমার সাক্ষাৎ লাভ তার কাছে অত্যন্ত প্রিয় মনে হবে।/আর মানব সমাজ খণির মত। জাহিলী যুগের উত্তম ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পরও উত্তম যদি তারা দ্বীনী ইল্ম অর্জন করে। তোমরা নেতৃত্ব ও শাসনের ব্যাপারে ঐ লোককেই সবচেয়ে উত্তম পাবে যে এর প্রতি অনাসক্ত, যে পর্যন্ত না সে তা গ্রহণ করে।

হাদীসে নেতৃত্বের লোভ করতে নিষেধ করে বলা হয়েছে নেতৃত্বের সূচনা আনন্দদায়ক হলেও পর্যায়ক্রমে তা কষ্টদায়ক হতে থাকে।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শীঘ্রই তোমরা ক্ষমতা ও নেতৃত্বের জন্য লালায়িত হয়ে পড়বে। আর এ কারণে নিশ্চয় কিয়ামতের দিন তোমরা লজ্জিত হবে। অতঃপর তা কতই না উত্তম দুধপানকারিণী এবং দুধ ছাড়ানোকারিণী কতই না মন্দ। (দুধ পান করলে শিশু ও মা যেমন আনন্দ পায় তেমনি মানুষ ক্ষমতা ও নেতৃত্ব লাভ করার মাধ্যমে আনন্দ পায়। আবার শিশুকে দুধ পান করানো ছেড়ে দিলে সে যেমন কষ্ট পায় অনুরূপ মানুষের ক্ষমতা চলে গেলে কষ্ট পায়। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেছেনঃ দুধপানকারিণী কতই না উত্তম পৃথিবীতে দুধ ছাড়ানোকারিণী কতই না মন্দ মৃত্যুর পরে। (ফাতহুল বারী ১৩শ খন্ড, হাঃ ৭১৪৮))

পরামর্শ ও অগ্রাধিকার

হাদীসে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতা বা আমীর নির্ধারণ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং প্রথমে যার নেতৃত্ব তথা যার প্রতি আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তার আনুগত্য করতে বলা হয়েছে এবং তার মৃত্যুর পর পরবর্তী আমীর নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে, এবং প্রথম বাইয়াত বা আনুগত্যপ্রাপ্ত বা প্রতিষ্ঠিত নেতার জীবদ্দশায় অপর কেউ নেতৃত্বের দাবি করলে কঠোরভাবে তাকে প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে।

জারীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইয়ামানে ছিলাম। এ সময়ে একদা যুকালা ও যু‘আমর নামে ইয়ামানের দু’ব্যক্তির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হল। আমি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস শোনাতে লাগলাম। (বর্ণনাকারী বলেন) এমন সময়ে যু‘আমর জারীর (রাঃ)-কে বললেন, তুমি যা বর্ণনা করছ তা যদি তোমার সাথীরই [নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর] কথা হয়ে থাকে তা হলে জেনে নাও যে, তিনদিন আগে তিনি ইন্তিকাল করে গেছেন। (জারীর বলেন, এ কথা শুনে আমি মদিনার দিকে ছুটলাম) তারা দু’জনেও আমার সঙ্গে সম্মুখের দিকে চললেন। অতঃপর আমরা একটি রাস্তার ধারে পৌঁছলে মদিনার দিক থেকে আসা একদল সওয়ারীর সাক্ষাৎ পেলাম। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত হয়ে গেছে। মুসলিমদের পরামর্শক্রমে আবূ বাকর (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হয়েছেন। তারপর তারা দু’জন (আমাকে) বলল, (মদিনা্য়) তোমার সাথী [আবূ বাকর (রাঃ)]-কে বলবে যে, আমরা কিছুদূর পর্যন্ত এসেছিলাম। সম্ভবত আবার আসব ইনশাআল্লাহ, এ কথা বলে তারা দু’জনে ইয়ামানের দিকে ফিরে গেল। এরপর আমি আবূ বাকর (রাঃ)-কে তাদের কথা জানালাম। তিনি বললেন, তাদেরকে তুমি নিয়ে আসলে না কেন? পরে আরেক সময় যু‘আমর আমাকে বললেন, হে জারীর! তুমি আমার চেয়ে অধিক সম্মানী। তবুও আমি তোমাকে একটি কথা জানিয়ে দিচ্ছি যে, তোমরা আরব জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা একজন আমীর মারা গেলে অপরজনকে (পরামর্শের ভিত্তিতে) আমীর বানিয়ে নেবে। আর তা যদি তরবারির জোরে ফায়সালা হয় তা হলে তোমাদের আমীরগণ রাজা বাদশাহর মতোই হয়ে যাবে। তারা রাজাদের রাগ করার মতই রাগ করবে। রাজাদের খুশি হওয়ার মতই খুশি হবে। (খলীফা ও খিলাফত আর অবশিষ্ট থাকবে না।)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:" ... আমার পরে কোনও নবী‎র আগমন ঘটবে না। বরং খলীফাগণ হবেন এবং তাঁরা সংখ্যায় অনেক হবেন’। তখন ছাহাবীগণ বললেন, ‘তাহলে আপনি (এ ব্যাপারে) আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন’? তিনি বললেন, ‘যার হাতে প্রথম বায়‘আত বা আনুগত্যের শপথ করবে, তাঁরই আনুগত্য করবে এবং তাদেরকে তাদের হক প্রদান করবে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে, যার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল’

আব্দুল্লাহ বিন আম্র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রনায়কের হাতে বায়াত করল এবং এতে তাকে নিজ প্রতিশ্রুতি ও অন্তস্তল থেকে অঙ্গীকার প্রদান করল তার উচিত, যথাসাধ্য তার (সেই নায়কের সৎবিষয়ে) আনুগত্য করা। এরপর যদি অন্য এক (নায়ক) তার ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাহলে ঐ দ্বিতীয় নায়কের গর্দান উড়িয়ে দাও।”

আরফাজাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যখন তোমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একই শাসকের শাসনাধীনে ঐক্যপূর্ণ, তখন যদি আর এক (শাসক) ব্যক্তি এসে তোমাদের সংহতি নষ্ট করতে চায় এবং জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে তাকে হত্যা করো।”

যোগ্য লোককে নেতৃত্বদান

বিশুদ্ধ বলে গণ্য সুন্নি হাদীসে যোগ্য লোককে নেতৃত্বভার দিতে বলা হয়েছে।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোকের এক মজলিসে হাদীস বয়ান করছিলেন, এমন সময় এক বেদুঈন এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, ’কিয়ামত কখন হবে?’ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়ান করতেই থাকলেন। অতঃপর বয়ান শেষ করে তিনি বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়? লোকটি বলল, ’এই যে আমি, হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, যখন আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর। লোকটি বলল, ’আমানত কীভাবে নষ্ট হবে?’ তিনি বললেন, যখন কোন অযোগ্য লোকের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর।/আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। সে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমানাত কিভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? তিনি বললেনঃ যখন কোন দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হবে, তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।

সক্ষমতা

হাদীসে দুর্বল লোককে নেতৃত্ব দিতে নিষেধ করা হয়েছে।

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম : হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি আমাকে (কোনো অঞ্চলের) শাসক নিযুক্ত করবেন না? তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার কাঁধে করাঘাত করে বললেনঃ হে আবূ যার! তুমি একজন দুর্বল প্রকৃতির লোক, আর শাসনকার্য হলো একটি আমানত। নিশ্চয় তা হবে কিয়ামতের দিন অপমান ও লাঞ্ছনা। তবে সে ব্যক্তি ব্যতীত, যে তা ন্যায়সঙ্গতভাবে মেনে নিয়েছে এবং নিষ্ঠার সাথে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে।অপর এক বর্ণনাতে আছে- তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেনঃ হে আবূ যার! আমি দেখছি তুমি একজন দুর্বলমনা লোক। আর আমি তোমার জন্য সেটাই পছন্দ করি, যা আমি নিজের জন্য পছন্দ করি। তুমি কক্ষনো দু’জন লোকেরও শাসক হয়ো (দায়িত্বভার নিও) না। আর ইয়াতীমের ধন-সম্পদের অভিভাবকও হয়ো না।

মুনাফিক না হওয়া

সালিহ আল মুনাজজিদ তার আননিফাক বইতে বলেন, ইসলামী নবী মুহাম্মদ কোন মুনাফিককে নেতা বানাতে নিষেধ করেছেন,

উবায়দুল্লাহ ইবন উমার (রহঃ) ..... আবদুল্লাহ ইবন বুরায়দা (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 'তোমরা কোন মুনাফিককে সাইয়্যিদ বা নেতা নামে আখ্যায়িত কর না। কেননা সে যদি সত্যিই (তোমাদের) নেতা হয়, তাহ'লে তোমরা তোমাদের প্রভুকে ক্ষুব্ধ করবে'।

রাষ্ট্রপ্রধান নারী না হওয়া

হাদীসে রাষ্ট্রপ্রধানের পদে নারীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

আবূ বাকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ সংবাদ আসলো যে, পারস্যের (ইরানের) অধিবাসীরা কিস্রার কন্যাকে তাদের সম্রাজ্ঞী নিযুক্ত করেছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে জাতি কক্ষনো সফলকাম হতে পারে না, যারা দেশের শাসনভার কোনো মহিলার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে।

চেয়ে নেতৃত্বে নিষেধাজ্ঞা

সালিহ আল মুনাজ্জিদ তার হুব্বুর রিয়াসাত (নেতৃত্বপ্রীতি) বইতে বলেছেন, বিশুদ্ধ বলে গণ্য সুন্নি হাদীসে চেয়ে নেতৃত্ব নিতে নিষেধ করা হয়েছে।

আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি এবং আমার চাচাতো দু’ভাই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট গেলাম। সে দু’জনের মধ্যে একজন বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মহান আল্লাহ আপনাকে যে সব শাসন-ক্ষমতা দান করেছেন, তার মধ্যে কিছু (এলাকার) শাসনভার আমাকে প্রদান করুন।’ দ্বিতীয়জনও একই কথা বলল। উত্তরে তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! যে সরকারী পদ চেয়ে নেয় অথবা তার প্রতি লোভ রাখে, তাকে অবশ্যই আমরা এ কাজ দিই না।”

আবূ সাঈদ আব্দুর রহমান ইবনে সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, “হে আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ! তুমি সরকারী পদ চেয়ো না। কারণ তুমি যদি তা না চেয়ে পাও, তাহলে তাতে তোমাকে সাহায্য করা হবে। আর যদি তুমি তা চাওয়ার কারণে পাও, তাহলে তা তোমাকে সঁপে দেওয়া হবে। (এবং তাতে আল্লাহর সাহায্য পাবে না।) আর যখন তুমি কোন কথার উপর কসম খাবে, অতঃপর তা থেকে অন্য কাজ উত্তম মনে করবে, তখন উত্তম কাজটা কর এবং তোমার কসমের কাফ্ফারা দিয়ে দাও।”

যোগ্যতা থাকলে ভালো কাজের নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার বৈধতা

তবে আমির আল ইয়ামিনী একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভালো কাজের নেতৃত্ব চেয়ে নেয়া জায়িয বলেও মত দেন।

‘উসমান ইবনু আবুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে আমার জাতির ইমাম নিযুক্ত করে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তাদের ইমাম। তবে ইমামতির সময় তাদের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য রেখ। একজন মুয়াযযিন নিযুক্ত করে নিও, যে আযান দেবার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে না।

মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র (রহঃ) ..... উসমান ইবনু আবূল আস সাকাকী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তুমি তোমাদের গোত্রের লোকেদের সালাতে ইমামতি কর। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার অন্তরে কিছু একটা অনুভব করি। তিনি আমাকে বললেন, নিকটে আসো। তিনি আমাকে তার সামনে বসালেন। অতঃপর আমার বুকের মাঝখানে তার হাত রাখলেন। তিনি পুনরায় বললেন, ঘুরে বসো। তিনি আমার পিছে কাঁধ বরাবর হাত রাখলেন। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি তোমার গোত্রের লোকেদের ইমামতি করো। যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ইমামতি করে সে যেন সালাত সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে বৃদ্ধ, অসুস্থ, দুর্বল এবং বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত লোক রয়েছে। তোমাদের কেউ যখন একাকি সালাত আদায় করবে, সে তখন নিজ ইচ্ছামত সালাত আদায় করতে পারে।

দ্বায়িত্বশীলতা

হাদীসে নেতৃত্বের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে সতর্ক করা হয়েছে।

হাসান বাসরী (রহ.) হতে বর্ণিত যে, ‘উবাইদুল্লাহ্ ইবনু যিয়াদ (রহ.) মাকিল ইবনু ইয়াসারের মৃত্যুশয্যায় তাকে দেখতে গেলেন। তখন মাকিল (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করছি যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, কোন বান্দাকে যদি আল্লাহ্ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।সহিহ বুখারী (তাওহিদ) ৭১৫০, [মুসলিম ১/৬৩, হাঃ ১৪২] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬৫)

আনুগত্য ও বিরোধিতা

ইসলামী নবী মুহাম্মদ মুসলিমদের মিলেমিশে থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং আমীর বা কর্তৃত্বশীল নেতা বা শাসকের ত্রুটিবিচ্যুতিতে বা অত্যাচারী হলেও ধৈর্যধারণ করে একতাবদ্ধ অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি তোমাদের উপর এমন কোন হাবশী দাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয়, যার মাথাটি কিশমিশের মত তবুও তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর। /সালামা ইবনু শাবীব (রহঃ) ... ইয়াহইয়া ইবনু হুসায়ন এর দাদী উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাবী (ইয়াহইয়া ইবনুু হুসাইন) বলেন যে, আমি তাকে বলতে শুনেছি- আমি বিদায় হজ্জে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হজ্জ আদায় করি। তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন অনেক কথাই বলেছিলেন। এরপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, যদি তোমাদের উপর কোন হাত পা কাটা গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয় (ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন বলেন) আমার মনে পড়ে তিনি (দাদী আরও) বলেছেন- কালো (অর্থাৎ কৃষ্ণকায় হাবশী/ (কাফরী) গোলাম) আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে। (আনুগত্য করবে)।

উক্ত রাবী [‘ইরবায ইবনু সারিয়াহ্] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ আমাদের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করালেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে গেলেন। আমাদের উদ্দেশে এমন মর্মস্পর্শী নাসীহাত করলেন যাতে আমাদের চোখ গড়িয়ে পানি বইতে লাগল। অন্তরে ভয় সৃষ্টি হলো মনে হচ্ছিল বুঝি উপদেশ দানকারীর যেন জীবনের এটাই শেষ উপদেশ। এক ব্যক্তি আবেদন করলো, হে আল্লাহর রসূল! আমাদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার, (ইমাম বা নেতার) আদেশ শোনার ও (তাঁর) অনুগত থাকতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী (কৃষ্ণাঙ্গ) গোলাম হয়। আমার পরে তোমাদের যে ব্যক্তি বেঁচে থাকবে সে অনেক মতভেদ দেখবে। এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নাতকে ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ি রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরা এবং এ পথ ও পন্থার উপর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দীনের ভেতরে নতুন নতুন কথার (বিদ্‘আত) উদ্ভব ঘটানো হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেকটা নতুন কথাই [বা কাজ শারী‘আতে আবিষ্কার করা যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ করেননি তা] বিদ্‘আত এবং প্রত্যেকটা বিদ্‘আতই ভ্রষ্টতা। (আহমাদ ও আবূ দাঊদ) কিন্তু এ বর্ণনায় তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়ের কথা উল্লেখ করেননি।

‘আলী ইবনু আবূ হাশিম হাশিম (রহঃ) ... ইয়াযীদ ইবনু ওহব (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাবাযা নামক স্থান দিয়ে চলার পথে আবূ যার (রাঃ) এর সাথে আমার সাক্ষাত হলো। আমি তাঁকে বললাম, আপনি এখানে কি কারণে আসলেন? তিনি বললেন, আমি সিরিয়ায় অবস্থানকালে নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে মু’আবিয়া (রাঃ) এর সাথে আমার মতানৈক্য হয়ঃ (الَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ) “যারা সোনা-ও রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না…।” মু’আবিয়া (রাঃ) বলেন, এ আয়াত কেবল আহলে কিতাবদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি বললাম, আমাদের ও তাদের সকলের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এক সময় মু’আবিয়া (রাঃ) ‘উসমান (রাঃ) এর নিকট আমার নামে অভিযোগ করে পত্র পাঠালেন। তিনি পত্রযোগে আমাকে মদিনায় ডেকে পাঠান। মদিনায় পৌছলে আমাকে দেখতে লোকেরা এত ভিড় করলো যে, এর পূর্বে যেন তারা কখনো আমাকে দেখেনি। ‘উসমান (রাঃ) এর নিকট ঘটনা বিবৃত করলে তিনি আমাকে বললেন, ইচ্ছা করলে আপনি মদিনার বাইরে নিকটে কোথাও থাকতে পারেন। এ হল আমার এ স্থানে অবস্থানের কারণ। খলীফা যদি কোন হাবশী লোককেও আমার উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন তবুও আমি তাঁর কথা শুনবো এবং আনুগত্য করব।

আহমাদ ইবন মানী (রহঃ) ....... ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে জাবিয়া নামক স্থানে ভাষণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হে লোকেরা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন আমাদের মাঝে দাঁড়াতেন তেমনি আমি আজ তোমাদের মাঝে দাঁড়িয়েছি। তিনি বলেছেন, আমি তোমাদেরকে আমার সাহাবীগণ সম্পর্কে ওয়াসীয়ত করে যাচ্ছি। এরপর যারা তাদের পরে আসবে, এরপর হল তারা যারা তাদেরও পরে আসবে। এরপর মিথ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। এমনকি একজন কসম করে বসবে অথচ তাকে কসম করতে বলা হয়নি। কোন সাক্ষী দিয়ে বসবে অথচ তাকে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়নি। শুনে রাখ, কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সঙ্গে নিভৃতে একত্রিত না হয় অন্যথায় শয়তান অবশ্যই তৃতীয় জন হিসাবে হাযির থাকে। তোমরা অবশ্যই মুসলিম জামাআতকে আকড়ে ধরে থাকবে। বিচ্ছিন্নতা থেকে বেঁচে থাকবে। শয়তান একাকী জনের সাথে থাকে। আর দুই জন থেকে সে আরো দূরে থাকে। যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম স্থান কামনা করে সে যেন জামাআতকে আকড়ে ধরে থাকে। নেক আমল যাকে আনন্দিত করে এবং মন্দ আমল যাকে দুঃখিত করে সেই হল মু’মিন। সহীহ, ইবনু মাজাহ ২৩৬৩, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২১৬৫ /২১৬৮

ইয়াহইয়া ইবন মূসা (রহঃ) ..... ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর হাত হল জামাআতের উপর।

আরফাজাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “অদূর ভবিষ্যতে বড় ফিতনা ও ফাসাদের প্রার্দুভাব ঘটবে। সুতরাং যে ব্যক্তি এই উম্মতের ঐক্য ও সংহতিকে (নষ্ট করে) বিচ্ছিন্নতা আনতে চাইবে সে ব্যক্তিকে তোমরা তরবারি দ্বারা হত্যা করে ফেলো; তাতে সে যেই হোক না কেন।”

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ যদি তার আমীর (ক্ষমতাসীন) থেকে এমন কিছু দেখে, যা সে অপছন্দ করে, তাহলে সে যেন ধৈর্য ধরে। কারণ, যে কেউ জামা’আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে মারা যাবে, তার মৃত্যু হবে জাহিলীয়্যাতের মৃত্যু।

মুহাম্মাদ ইবনু সাহল ইবনু আসকার তামীমী ও আবদুল্লাহ ইবনু আবদুর রহমান দারিমী (রহঃ) ..... হুযাইফাহ ইবনু ইয়ামান (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমরা ছিলাম অকল্যাণের মধ্যে; তারপর আল্লাহ আমাদের জন্য কল্যাণ নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ কল্যাণের পিছনে কি আবার কোন কল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, এ কল্যাণের পিছনে কি আবার কোন অকল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ! আমি বললাম, তা কীভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে, যারা আমার হিদায়াতে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তির উদ্ভব হবে, যাদের আত্মা হবে মানব দেহে শাইতানের আত্মা। রাবী বলেন, তখন আমি বললাম, তখন আমরা কী করবো হে আল্লাহর রসূল! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন, তুমি আমীরের কথা শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্ৰাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেয়া হয়, তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।

মুহাম্মাদ ইবনু মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ) ..... ওয়ায়িল হাযরামী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সালামাহ্ ইবনু ইয়াযীদ আল জু'ফী (রাযিঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ মর্মে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর নবী! যদি আমাদের উপর এমন শাসকের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যে, তারা তাদের হক তো আমাদের কাছে দাবী করে কিন্তু আমাদের হক তারা দেয়না। এমতাবস্থায় আপনি আমাদেরকে কী করতে বলেন? তিনি তার উত্তর এড়িয়ে গেলেন। তিনি আবার তাকে প্রশ্ন করলেন। আবার তিনি এড়িয়ে গেলেন। এভাবে প্রশ্নকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারও একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। তখন আশ'আস ইবনু কায়স (রাযিঃ) তাকে (সালামাকে) টেনে নিলেন এবং বললেন, তোমরা শুনবে এবং মানবে। কেননা তাদের উপর আরোপিত দায়িত্বের বোঝা তাদের উপর বর্তাবে আর তোমাদের উপর আরোপিত দায়িত্বের বোঝা তোমাদের উপর বর্তাবে।/ আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ) ..... সিমাক (রহঃ) হতে উক্ত সানাদে অনুরূপ বর্ণনা করেন। এ বর্ণনাতে আছে, আশ'আস ইবনু কায়স তাকে টেনে নিলেন, অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা শুনবে ও মানবে। কেননা তাদের দায়িত্বের বোঝা তাদের উপর এবং তোমাদের দায়িত্বের বোঝা তোমাদের উপর বর্তাবে।"

হাদীসে নেতা শাসক ও ক্ষমতাসীনদের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে, যখন তারা ইসলামী কাজের (হালাল) নির্দেশ দেয়, আর অনৈসলামিক কাজে (হারাম) তাদের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।

(রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,) যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলারই আনুগত্য করল আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করল, সে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলারই নাফরমানী করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের ('আরবি শব্দ আমর (আদেশ, নির্দেশ, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা) হতে উদ্ভুত, আদেশদাতা, নেতা, কর্তৃত্বশীল, ক্ষমতাসীন, শাসক) আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আমারই আনুগত্য করল আর যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানী করল সে ব্যক্তি আমারই নাফরমানী করল। ইমাম (নেতা) তো ঢাল স্বরূপ। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ এবং তাঁরই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। অতঃপর যদি সে আল্লাহর তাকওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, তবে তার জন্য এর পুরস্কার রয়েছে আর যদি সে এর বিপরীত করে তবে এর মন্দ পরিণাম তার উপরই বর্তাবে।

আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ) ..... উবাদাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে বাই’আত হলাম এ মর্মে যে, আমরা শুনবো ও মানবো, সংকটের সময় ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময়, খুশীর অবস্থায় ও অপছন্দের অবস্থায় এবং আমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দিলেও। আর এ মর্মে যে, আমরা যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব বরণ করে নিতে কোনরূপ কোন্দল করবো না। আর এ মর্মে যে, আমরা যেখানেই থাকবো হক কথা বলব। আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভৎসনাকারীর ভৎসনাকে ভয় করবো না।

আবদুল্লাহ্ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেনঃ যতক্ষণ আল্লাহর নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া না হয়, ততক্ষণ পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য তার (ইমামের বা নেতার) মান্যতা ও আনুগত্য করা কর্তব্য। যখন নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া হয়, তখন আর কোন মান্যতা ও আনুগত্য নেই।

হুযাইফাহ ইবনু ইয়ামান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকজন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন আর আমি তাঁকে অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম; এই ভয়ে যেন আমি ঐ সবের মধ্যে পড়ে না যাই। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা জাহিলীয়্যাতে অকল্যাণকর অবস্থায় জীবন যাপন করতাম অতঃপর আল্লাহ আমাদের এ কল্যাণ দান করেছেন। এ কল্যাণকর অবস্থার পর আবার কোন অকল্যাণের আশঙ্কা আছে কি? তিনি বললেন, হাঁ, আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ অকল্যাণের পর কোন কল্যাণ আছে কি? তিনি বললেন, হাঁ, আছে। তবে তা মন্দ মেশানো। আমি বললাম, মন্দ মেশানো কী? তিনি বললেন, এমন একদল লোক যারা আমার সুন্নাত ত্যাগ করে অন্যপথে পরিচালিত হবে। তাদের কাজে ভাল-মন্দ সবই থাকবে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, অতঃপর কি আরো অকল্যাণ আছে? তিনি বললেন হাঁ, তখন জাহান্নামের দিকে আহবানকারীদের উদ্ভব ঘটবে। যারা তাদের ডাকে সাড়া দিবে তাকেই তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এদের পরিচয় বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং কথা বলবে আমাদেরই ভাষায়। আমি বললাম, আমি যদি এ অবস্থায় পড়ে যাই তাহলে আপনি আমাকে কী করতে আদেশ দেন? তিনি বললেন, মুসলিমদের দল ও তাঁদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, যদি মুসলিমদের এহেন দল ও ইমাম না থাকে? তিনি বলেন, তখন তুমি তাদের সকল দল উপদলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে এবং মৃত্যু না আসা পর্যন্ত বৃক্ষমূল দাঁতে আঁকড়ে ধরে হলেও তোমার দ্বীনের উপর থাকবে।

যুহায়র ইবনু হারব ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ..... 'আবদুর রহমান ইবনু আবদ রাব্বিল কা'বা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদা মসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন 'আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আস (রাযিঃ) কাবার ছায়ায় বসেছিলেন। লোকজন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরেছিল। আমি তাদের নিকট গেলাম এবং তার পাশেই বসে পড়লাম। তখন তিনি বললেন, কোন সফরে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। আমরা একটি অবস্থান গ্রহণ করলাম। আমাদের মধ্যকার কেউ তখন তার তাবু ঠিকঠাক করছিল, কেউ তীর ছুড়ছিল, কেউ তার পশুপাল দেখাশুনা করছিল। এমন সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নকীব হাঁক দিল নামাযের ব্যবস্থা প্রস্তুত! তখন আমরা গিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশে মিলিত হলাম।

তিনি বললেনঃ আমার পূর্বে এমন কোন নবী অতিবাহিত হননি যার উপর এ দায়িত্ব বর্তায়নি যে, তিনি তাদের জন্য যে মঙ্গলজনক ব্যাপার জানতে পেরেছেন তা উম্মাতদেরকে নির্দেশনা দেননি এবং তিনি তার জন্য যে অনিষ্টকর ব্যাপার জানতে পেরেছেন, সে বিষয়ে তাদেরকে সাবধান করেননি। আর তোমাদের এ উম্মাত (উম্মাতে মুহাম্মাদ)-এর প্রথম অংশে তার কল্যাণ নিহিত এবং এর শেষ অংশ অচিরেই নানাবিধ পরীক্ষা ও বিপর্যয়ের এবং এমন সব ব্যাপারের সম্মুখীন হবে, যা তোমাদের নিকট অপছন্দনীয় হবে। এমন সব বিপর্যয় একাদিক্রমে আসতে থাকবে যে, একটি অপরটিকে ছোট প্রতিপন্ন করবে। একটি বিপর্যয় আসবে তখন মু'মিন ব্যক্তি বলবে- এটা আমার জন্য ধ্বংসাত্মক, তারপর যখন তা দূর হয়ে অপর বিপর্যয়টি আসবে তখন মুমিন ব্যক্তি বলবে, আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি ইত্যাদি।

সুতরাং, যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে চায় এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে চায় তার মৃত্যু যেন এমন অবস্থায় আসে যে, সে আল্লাহ ও আখিরাতের দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং সে যেন মানুষের সাথে এমনি আচরণ করে যে আচরণ সে তার নিজের জন্য পছন্দ করে। আর যে ব্যক্তি কোন ইমাম (বা নেতা) এর হাতে বাই’আত হয়— আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে তার হাতে হাত দিয়ে এবং অন্তরে সে ইচ্ছা পোষণ করে, তবে সে যেন সাধ্যানুসারে তার আনুগত্য করে যায়। তারপর যদি অপর কেউ তার সাথে (নেতৃত্ব লাভের অভিলাষে) ঝগড়ায় প্রবৃত্ত হয় তবে ঐ পরবর্তী জনের গর্দান উড়িয়ে দেবে। (রাবী বলেন) তখন আমি তার নিকটে ঘেষলাম এবং তাকে বললাম, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি সত্যিই আপনি (নিজ কানে) কি তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে শুনেছেন? তখন তিনি তার দু’কান ও অন্তঃকরণের দিকে দু'হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন, আমার দু’কান তা শুনেছে এবং আমার অন্তঃকরণ তা সংরক্ষণ করেছে।

তখন আমি তাকে লক্ষ্য করে বললাম, ঐ যে আপনার চাচাতো ভাই মু'আবিয়্যাহ্ (আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন) তিনি আমাদেরকে আদেশ দেন যেন আমরা আমাদের পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করি আর নিজেদের মধ্যে পরস্পরে হানাহানি করি অথচ আল্লাহ বলেছেন, "হে মু’মিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, ব্যবসার মাধ্যমে পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যতীত এবং তোমরা পরস্পরে হানাহানি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান"- (সূরা আন নিসা ৪ঃ ২৯)। রাবী বলেন, তখন তিনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারসমূহে তুমি তার আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর অবাধ্যতার বিষয়গুলোতে তার অবাধ্যতা করবে।

নেতাকে গোপনে পরামর্শ দেওয়া

ইসলামী নবী মুহাম্মদ শাসককে নসীহত বা পথপ্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, এবং তা গোপনে করতে বলেছেন।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা তিনটি কাজ পছন্দ করেন এবং তিনটি কাজ অপছন্দ করেন। তোমাদের জন্য তিনি যা পছন্দ করেন, তা হলঃ ১. তোমরা তারই ইবাদাত করবে, ২. তার সঙ্গে কিছুই শারীক করবে না এবং ৩. তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু মজবুতভাবে ধারণ করবে ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। "আর তোমাদের উপর আল্লাহ যাকে শাসক বানিয়েছেন তাকে নসীহত কর।" (وأن تناصحوا من ولاه الله أمركم،) আর যে সকল বিষয় তিনি তোমাদের জন্য অপছন্দ করেনঃ ১. নিরর্থক কথাবার্তা বলা, ২. অধিক প্রশ্ন করা এবং ৩. সম্পদ বিনষ্ট করা।

ইবনে আবী 'আসিম এবং অন্যান্যগণ কর্তৃক বর্ণিত ইয়ান ইবনে গাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

من أراد أن ينصح لذي سلطان قلا يبده علانية، ولكن يأخذ بيده فيخلوا به، فإن قبل منه فذاك، وإلا كان قد أدى الذي عليه»

“যদি কেউ ক্ষমতাধর কাউকে নসীহত করতে চায় সে যেন তা প্রকাশ্যে না করে, বরং সে যেন তার হাত ধরে (অর্থাৎ গোপনে বলে) যদি সে তা গ্রহণ করল তবে তার কাজে আসল, আর যদি গ্রহণ না করল তাহলে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আদায় করল।”

নেতৃত্বে বৈধতার মানদণ্ডঃ নামাজের অনুমতি দেওয়া

খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বইতে বলেন, হাদীসে ততক্ষণ পর্যন্ত শাসকের ক্ষমতার বিরোধিতা করতে নিষেধ করা হয়েছে, যতক্ষণ তারা নামাজ পড়ে এবং/অথবা প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়।

৪৬৯৪-(৬২/১৮৫৪) হাদ্দাব ইবনু খালিদ আযদী (রহঃ) ..... উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অচিরেই এমন কতক আমীরের উদ্ভব ঘটবে তোমরা তাদের চিনতে পারবে এবং অপছন্দ করবে। যে ব্যক্তি তাদের স্বরূপ চিনল সে মুক্তি পেল এবং যে ব্যক্তি তাদের অপছন্দ করল নিরাপদ হলো। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের পছন্দ করল এবং অনুসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হল)। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায়কারী থাকবে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৬৪৭, ইসলামিক সেন্টার ৪৬৪৯)

ইসহাক ইবনু ইবরাহীম হানযালী (রহঃ) ..... আওফ ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের সর্বোত্তম নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ভালবাস আর তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে। তারা তোমাদের জন্য দু'আ করে, তোমরাও তাদের জন্য দু'আ কর। পক্ষান্তরে তোমাদের নিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর আর তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাদেরকে তরবারি দ্বারা প্রতিহত করবো না? তখন তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়িম রাখবে। আর যখন তোমাদের শাসকদের মধ্যে কোনরূপ অপছন্দনীয় কাজ দেখবে; তখন তোমরা তাদের সে কাজকে ঘৃণা করবে; কিন্তু (তাদের) আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।

গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি

হাদীসে আসাবিয়াত বা গোত্রপ্রীতিকে তিরষ্কার ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ওয়াছিলা ইবনে আসকা রা. বলেন, একদিন আমি রসুল সা.-কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আসাবিয়াত বা গোত্রপ্রীতি কি? রসুল সা. বললেন, আসাবিয়াত হলো তোমার গোত্রকে অন্যায় ব্যাপারে সাহায্য করা।

যুবাইর ইবনে মুতইম রা. বলেন, রসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের বা গোত্রপ্রীতির দিকে লোকদেরকে আহ্বান করে, নিজে আসাবিয়াতের ওপর যুদ্ধ করে এবং আসাবিয়াতের ওপর মৃত্যুবরণ করে, সে ব্যক্তি আমাদের দলের নয়।

হুরায়ম ইবনু আবদুল আ'লা (রহঃ) ..... জুনদাব ইবনু আবদুল্লাহ বাজালী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লক্ষ্যহীন নেতৃত্বের পতাকাতলে যুদ্ধ করে, গোত্র প্রীতির (عَصَبِيَّةً, আসাবিয়্যাতান) দিকে আহ্বান জানায় এবং গোত্রপ্রীতির (عَصَبِيَّةً, আসাবিয়্যাতান) কারণেই সাহায্য করে, তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু।

বিশর ইবন হিলাল সাওওয়াফ (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য হতে বের হয়ে যায় এবং মুসলিমদের দল ত্যাগ করে, আর এই অবস্থায় মারা যায়, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে ভাল-মন্দ নির্বিচারে হত্যা করে এবং মুসলিমকেও ছাড়ে না; আর যার সাথে যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তার অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার সাথে আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে, আর লোকদেরকে জাত্যাভিমানের দিকে আহ্বান করে এবং তার ক্রোধ জাত্যাভিমানের জন্যই হয়, পরে সে নিহত হয়; তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে।

উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি নিজেকে জাহিলিয়্যাতের গৌরবে গৌরবান্বিত করে, তাকে তার পিতার (পিতৃ-পুরুষের) বস্তুর (লজ্জাস্থানের) সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে রাখো। আর এ কথাগুলো তাকে ইঙ্গিতে নয়; বরং পরিষ্কার ভাষায় বলে দাও। (যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের যুগের আদব-কায়দায় তার বংশগত, দলগত, জাতিগত প্রভৃতি আত্মঅহমিকামূলক সম্পর্কের কথা বলে গর্ব করে, তাকে মানুষ হিসেবে তার উৎপত্তি ও বাস্তবতা এবং তার পূর্বপুরুষদের অবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাকে লজ্জিত করা হোক।”)

নুফায়লী (রহঃ) ..... আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তার কাওমের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে তার উদাহরণ এরূপ যে, যেমন কারও উট গর্তে পড়ে গেছে, আর সে তার লেজ ধরে টানছে। (অর্থাৎ সে উটকে উদ্ধার করা যেমন সম্ভব নয়, ঐরূপ ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোও কঠিন।)

আবূ বকর ইবন আবূ শায়বা (রহঃ) ..... আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন কাওমের ভাতিজা, সে কাওমেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহ তোমাদের জাহিলী যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদেরকে নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মু’মিন হলো আল্লাহভীরু আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সকলে আদম সন্তান আর আদম (আ.) মাটির তৈরি। লোকেদের উচিত বিশেষ গোত্রেরভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা। এখন তো তারা জাহান্নামের কয়লায় পরিণত হয়েছে। অন্যথায় তোমরা মহান আল্লাহর নিকট ময়লার সেই কীটের চেয়ে জঘন্য হবে যে তার নাক দিয়ে ময়লা ঠেলে নিয়ে যায়।

হাদীসে স্বজনপ্রীতি দেখলে বিশৃঙ্খলা না করে নিজ দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে।

আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা খুব শীঘ্রই আমার পরে স্বজনপ্রীতি (স্বার্থপরতা), পক্ষপাতিত্ব ও তোমাদের অপছন্দনীয় অনেক বিষয় দেখতে পাবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ সময়ে কি করার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেন? তিনি বললেনঃ তোমাদের উপর তাদের যে অধিকার রয়েছে তোমরা তা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের অধিকার আল্লাহ্ তা'আলার নিকট প্রার্থনা করবে।

জনগণের দুর্নীতির ফলে অত্যাচারী শাসকের আবির্ভাব

। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেনঃ হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, শাসকের তরফ থেকে অত্যাচার কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠ চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন।

ফিকহশাস্ত্রে

ইবনে তাইমিয়া তার সিয়াসাহ শারিয়াহ বইতে বলেন, নেতা বা শাসকবিহীন অবস্থায় এক রাত থাকার চেয়ে অত্যাচারী শাসকের অধীনে ৬০ বছর থাকাও অধিক উত্তম।

নাসিরুদ্দিন আলবানী তার দারসুশ শাইখুল আলবানী গ্রন্থে বলেন, হে মুসলিমগণ, রাজনীতি থেকে দুরে থাকা রাজনীতির অন্তর্ভূক্ত (أيّها المتأسلمون: من السياسة ترك السياسة) (মিন আস-সিয়াসাহ তারাকা আল-সিয়াসাহ, রাজনীতি থেকে(ই আসে) রাজনীতি ত্যাগ করা(র বিষয়টি)/রাজনীতি ত্যাগ করার বিষয়টি রাজনীতি থেকেই আসে/এসেছে)। সেখানে তিনি বলেন,

প্রশ্নঃ আমাদেরকে প্রথমে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা একটি সমালোচিত বিষয় সম্পর্কে, তাই আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক, কারণ আপনি তাবলিগ জামাতের বহু সমালোচিত বিষয় সম্পর্কে আপনার মতামত দেওয়ার মানসিক শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন, কিন্তু এখানে আরও কিছু সমালোচিত বিষয় রয়েছে যেগুলো অন্যান্য দৃষ্টিকোণ সম্পর্কিত, যেগুলোর উত্তর আমরা জানতে চাই, মূলত সংক্ষেপে, এরপর বিশদভাবে, আল্লাহ আপনাকে রহম করুনঃ প্রশ্নকর্তা বলেনঃ তাবলিগ জামাতের একটি মূলনীতি সম্পর্কে আপনি কি বলেন, যাতে তারা বলেঃ আমরা বাহিরে (দাওয়াতী কাজে) বের হওয়ার সময় চারটি বিষয়ে কথা বলি না, ঐ চারটি বিষয়ে কথা বলার ফলে ফিতনা তৈরি হওয়ার কারণে, এগুলো হলোঃ রাজনীতি, ফিকহ, মতানৈক্য বা ইখতিলাফ ও দলীয় পার্থক্য? উত্তরঃ আর আমরা আল্লাহর কাছে দোআ করি আল্লাহ তাদের পথ দেখাক! প্রাথমিকভাবে আমরা রাজনীতির বিষয়ে তাদের সাথে একমত, কিন্তু সামগ্রিকভাবে না। একে আমরা যেভাবে দেখি, তা আমি এর আগে একাধিকবার বলেছি। আমরা সিরিয়াতে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলাম, আর সেখানে আমরা গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা প্রশ্নের সম্মুখীন হই, দুর্ভাগ্যবশত যেমনটা তারা প্রতিটি মুসলিম দেশে করে থাকে: তোমরা সমাবেশ করছো, দল করছো, এমন ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমি বললামঃ এই দল সংস্কারের জন্য, রাজনীতির জন্য নয়, আর এক ঘন্টারও বেশি সময়ের একটি দীর্ঘ আলোচনার পর যখন এই বা'সপন্থী (বাস পার্টি বা হিজবুল বাস, সিরিয়ার একটি রাজনৈতিক দল) প্রশ্নকর্তাটি আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমলে নেওয়ার মত কোন পথ পেলো না, সে বললোঃ তাহলে যাও, গিয়ে তোমার দরস (শিক্ষা) দিতে থাকো, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলো না, যদিও আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বললামঃ আমরা সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে নিজের দিকে ডাক দেই, তা হলো কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা যেমনটি আপনারা সবসময় ও সারাজীবন শুনে থাকেন, আর আমি এর আগে তা ব্যাখ্যাসহ বলেছি, কিন্তু এখন আপনি আবার সেই কথায় ফিরে গেলেনঃ কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ো না। তাই এটি আমাকে বাধ্য করছে আপনার কাছে কিছু বিষয় তুলে ধরার জন্য। এটি সত্য যে, আমরা রাজনীতিতে জড়াই না। কারণ রাজনীতিতে জড়ানো ইসলামের অংশ না, একথা ঠিক নয়। রাজনীতি ইসলামের অংশ, আর কিছু ইসলামী আলেমগণ ইবনে তাইমিয়ার "সিয়াসাহ শরিয়াহ, কাদিমান ওয়া হাদিসান" (শরিয়াহর (রাজ)নীতি, অতীত ও বর্তমান) বইটির সাথে পরিচিত। ইসলামী রাষ্ট্রও রাজনীতির বাইরে পড়ে না, আর রাজনীতি (সিয়াসাত) শব্দের অর্থ কি? তা হলোঃ মানুষের বা জনগণের নীতি (সিয়াসাতুন নাস, বিঃ দ্রঃ আরবিতে নীতি ও রাজনীতি উভয়কেই সিয়াসাত শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়) এবং তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান প্রতিষ্ঠা করা, তাদের ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থ অনুযায়ী। আমরা নিজেদেরকে রাজনীতির সাথে জড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করি না, কিন্তু আমরা দেখেছি - আর এ ব্যাপারে আমাদের সাক্ষ্যপ্রমাণও আছে - তা হলো - রাজনীতি ত্যাগ করা রাজনীতিরই অংশ। রাজনীতিতে অংশ নিতে হয় সাময়িক বা অস্থায়ীভাবে, কিন্তু তা ত্যাগ করা যায় না, তা নাহলে এমন রাজনীতি ছাড়া কীভাবে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে? কিন্তু যাদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিৎ তাদের অবশ্যই আলেম হতে হবে, আলেম হতে হবে কিতাব (কুরআন) ও সুন্নত (ইসলামী নবী মুহাম্মাদের আদর্শ) এর সঠিক বুঝ ও সালফে সালেহীনদের বুঝ অনুসারে ইত্যাদি, আর এজন্য আমরা তাদের (তাবলীগ জামাতের) সাথে এই বিষয়ে একমত প্রাথমিকভাবে, আমরা সাধারণভাবে তাদের সাথে একমত, কিন্তু বিশদভাবে আমরা তাদের সাথে একমত নই, তাই এখন আমরা বলি: রাজনীতি ত্যাগ করা রাজনীতিরই অংশ।

ইখওয়ানুল মুসলিমিন ও সমমনা মুসলিম দলগুলো আলবানীর এই মতের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, এর দ্বারা আলবানী ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করেছন। আলবানীর অনুগামীগণ এর বিরোধিতা করে বলেন, এখানে রাজনীতি বলতে ইসলামের নামে ক্ষমতা, সম্মান ও অর্থলোভের প্রতিযোগিতামূলক অপরাজনীতিকে বোঝানো হয়েছে। ইসলামী সমাজ বিনির্মানের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলবানী তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহ (আত্মশুদ্ধির ও প্রশিক্ষণ,এর গুরুত্ব দিয়ে বলেন,

বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা হ’ল এই যে, তারা বস্ত্তগত শক্তিতে বলীয়ান কাফের রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং এমন সব শাসকদের হাতে নিপীড়িত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে না, আর করলেও তা খুব সামান্যই। যার ফলে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমি মনে করি মুসলিম দলগুলোকে কেবল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমি বিশ্বাস করি না এ দু’টি বিষয় ছাড়া মুসলমানদের এই দুর্বলতা, লাঞ্ছনা ও অপমান-অপদস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় আছে। আমি সকল বিশ্বাসী মুসলিম ভাই-বোনদেরকে বিশেষতঃ সচেতন ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবকদেরকে বলছি, প্রথমত যে বিষয়টি আমাদের জানতে হবে তা হ’ল, মুসলমানদের করুণ পরিস্থিতি। আর দ্বিতীয়তঃ যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে তা হ’ল, সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে তা থেকে মুক্তির উপায় বের করার পথ অনুসন্ধান করা। কোটি কোটি মুসলমান আজ কেবল ভৌগোলিক বাস্তবতা অথবা নিজের আত্মপরিচয় রক্ষার্থে মুসলিম। অর্থাৎ নিজের জাতীয়তা, পরিচয়পত্র এবং জন্মসনদে লিপিবদ্ধ পরিচিতি মোতাবেক মুসলিম। আজকে আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছুই বলব না। আমি পুনরায় সকলকে বলব, ঐ মুক্তিকামী যুবকদের হাতে মুক্তির কেবল দু’টি পথই খোলা আছে- (১) তাছফিয়াহ বা আক্বীদা সংশোধন (২) তারবিয়াত বা আমলী প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। তাছফিয়াহ হ’ল, মুসলিম যুবকদের নিকটে সেই বিশুদ্ধ ইসলামকে উপস্থাপন করা, যা যুগের পরিক্রমায় অনুপ্রবিষ্ট ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস, কুসংস্কার, বিদ‘আতসহ সকল প্রকার জাল-যঈফ হাদীছ হ’তে মুক্ত। এই আক্বীদাগত সংস্কারকে বাস্তবায়িত করা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। এই সংস্কার ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে কাংখিত শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার কোন সুযোগ নেই। এই ‘তাছফিয়াহ’র উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলামকে একমাত্র চিকিৎসা হিসাবে উপস্থাপন করা, যা অনুরূপভাবে সেই আরবদের চিকিৎসা করেছিল, যারা একদিকে পারসিক, রোমীয়, হাবশীদের কাছে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত অবস্থায় পতিত ছিল। অন্যদিকে আল্লাহর পরিবর্তে গায়রুল্লাহর ইবাদত করতো। এই অবস্থান থেকে আমরা সকল ইসলামী দল ও গোষ্ঠীর বিরোধিতা করি এবং বিশ্বাস করি অবশ্যই তাছফিয়াহ এবং তারবিয়াত একত্রে শুরু করতে হবে। যদি আমরা রাজনীতি দিয়ে শুরু করি তাহ’লে আমরা দেখতে পাব যে, যারা এখন রাজনীতিতে ডুবে রয়েছে, তাদের আক্বীদা বিনষ্ট। আর ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আচার-আচরণ অনেকটাই শরী‘আতবহির্ভূত। তারা কেবল আমভাবে ইসলামের নামে মানুষ জমায়েত করতেই ব্যস্ত। অথচ তাদের লক্ষ্য ও চিন্তাধারা সম্পর্কে ঐসব আমজনতার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে ইসলামের কোন প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের ব্যক্তিজীবনেই ইসলামী বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করে না, যা তাদের পক্ষে সহজেই সম্ভবপর ছিল। অথচ একই সময়ে তারা উঁচু গলায় শ্লোগান দিচ্ছে لا حكم إلا لله ‘আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কোন হুকুম চলবে না!’। বক্তব্যটি ঠিকই যে, অবশ্যই আল্লাহ নাযিলকৃত হুকুম ব্যতীত অন্য কোন হুকুম চলবে না। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, فاقد الشيء لا يعطيه অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি নিজে যা হারিয়েছে, সে অন্যকে তা দিতে পারে না’। আধুনিক কালের অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করে যদি অন্যদের কাছে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী ভূমিকা কামনা করে, তবে কখনোই তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হবে না। কেননা কেউ যদি কোন জিনিস নিজেই হারিয়ে ফেলে, তবে তা অন্যকে দিতে পারে না। আর ঐসব শাসকগণ তো এই উম্মতেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই শাসক-শাসিত উভয়কেই এ দুর্বলতার কারণ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে কেন মুসলিম শাসকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামের বিধান অনুযায়ী শাসন করছে না? কেন মুসলিম দাঈগণ অন্যদেরকে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আহবান জানানোর পূর্বে নিজেদের জীবনে ইসলামী বিধান কার্যকর করছেন না। এর জওয়াব একটাই-তাদের কারোরই হয় ইসলাম সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান ছাড়া সঠিক জ্ঞান বা বুঝ নেই অথবা তারা চলাফেরা, জীবনযাপন, স্বভাবচরিত্র, পারস্পরিক লেনদেন কোন ক্ষেত্রেই ইসলামী মূল্যবোধের উপর গড়ে উঠেনি। ফলে আমার অভিজ্ঞতাবলে আমি যা বলতে পারি তারা বড় ধরনের ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। আর সেটি হ’ল দ্বীনের সঠিক বুঝ থেকে দূরে ছিটকে পড়া। এমনকি আজকের দিনে কোন কোন দাঈ মনে করেন যে, সালাফীরা কেবল তাওহীদের দাওয়াতেই জীবনপাত করে গেল। সুবহানাল্লাহ, কতই না মূর্খতায় ডুবে আছে সেই ব্যক্তি, যে অজ্ঞতাবশতঃ এমন কথা বলে। যদি সে প্রকৃতপক্ষে গাফেল নাও হয়, তবুও সকল নবী ও রাসূলের দাওয়াত সম্পর্কে তার জানার কমতি আছে। কেননা সকল নবীর দাওয়াত ছিল, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বেঁচে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। নূহ (আঃ) ৯৫০ বছর যাবৎ কেবল এই দাওয়াতই দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নতুন কোন সংস্কার করেননি, কোন বিধান প্রবর্তন করেননি, কোন রাজনীতি করেননি। বরং তিনি কেবল বলেছিলেন, হে আমার কওম! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বেঁচে থাক’। এটাই ছিল পূর্ববর্তী সালাফ আম্বিয়ায়ে কেরামের কার্যক্রম! তাহ’লে এই সকল মুসলিম দাঈগণ কীভাবে এত নীচে নেমে যেতে পারেন যে, তারা সেই একই কার্যক্রমের জন্য সালাফীদের নিন্দা করেন? দ্বিতীয় উপায় হ’ল তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ। যুবকদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে যেন তারা পূর্ববর্তীদের মত দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَاللهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ. وَلَكِنِّى أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ ‘আল্লাহর কসম! তোমরা দারিদ্রে্য নিপতিত হবে এ আশংকা আমি করি না। বরং আমি ভয় করি যখন তোমাদের সামনে দুনিয়াবী চাকচিক্যের দুয়ার উন্মুক্ত হবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত। ফলে তাদের মত তোমরাও পরস্পর সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে এবং তা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে, যেভাবে ধ্বংস করেছিল পূর্ববর্তীদেরকে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৬৩)। আরেকটি রোগ থেকে মুসলমানদের অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে যেন কোনভাবেই তা হৃদয়ে স্থান না পেতে পারে। তা হ’ল, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে ভয় না করা (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫৩৬৯)। এটা এমন একটি রোগ যার চিকিৎসা করা এবং মানুষকে তা থেকে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এর সমাধানটি একটি হাদীছের শেষাংশে রাসূল (ছাঃ) উল্লেখ করেছেন এভাবে, حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ ‘যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনের পথে ফিরে আসবে’ (আবুদাঊদ হা/৩৪৬২)। অর্থাৎ মুক্তির পথ প্রতিভাত হবে বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে ফিরে আসার মাধ্যমে, যে দ্বীনের উপর অটুট ছিলেন রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ ‘যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। মুফাসসিরগণ একমত যে, অত্র আয়াতে আল্লাহকে সাহায্য করা অর্থ হ’ল, তাঁর হুকুম-আহকাম অনুযায়ী আমল করা। সুতরাং আল্লাহকে সাহায্য করা যদি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন না করা ব্যতীত অসম্ভব হয়, তাহ’লে আমরা কীভাবে বাস্তব জিহাদে অবর্তীণ হব, যখন আমরা আল্লাহকে সাহায্য করছি না? কেননা আমাদের আক্বীদা যেমন অশুদ্ধ, নৈতিকতাও তেমন ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়েছে। সুতরাং জিহাদ শুরুর পূর্বে এই অবহেলা-উন্নাসিকতা আর বিবাদ-বিসম্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টাই হবে আমাদের আবশ্যকীয় প্রাথমিক কর্মসূচি। আল্লাহ বলেন, لاَ تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘তোমরা পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহ’লে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে’ (আনফাল ৮/৪৬)। সুতরাং যখন আমরা এই মতবিরোধ ও গাফিলতির পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হব এবং তদস্থলে পারস্পরিক ঐক্য-ভালোবাসার জাগরণ সৃষ্টি করতে পারব, তখন সেটাই হবে আমাদের দুনিয়াবী শক্তির মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন,أَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ ‘তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত কর’ (আনফাল ৮/৬০)। চারিত্রিক দিক থেকেও মুসলমানদের অবস্থা ধ্বংসাত্মক এবং মারাত্মক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তাইতো সালাফী নন এমন একজন বিখ্যাত মুসলিম দাঈর বক্তব্য (কাযী হাসান হুযায়মী) আমাকে বিস্মিত করেছে, যদিও তাঁর অনুসারীরা তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী চলেন না। তিনি বলেছেন, أَقِيْمُوْا دَوْلَةَ الْإِسْلاَمِ فِيْ قُلُوْبِكُمْ تُقَمْ لَكُمْ فِيْ أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’। অধিকাংশ দাঈ ভুল করেন যখন তারা আমাদের এই মূলনীতিকে অবহেলা করেন। একই ভুল করে বসেন যখন তারা বলে বসেন,إن الوقت ليس وقت التصفية والتربية ، وإنما وقت التكتل والتجمُّع, এখন তো তাছফিয়াহ ও তারবিয়াতের সময় নয়। বরং এখন তো ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার সময়’। অথচ এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া কীভাবে সম্ভব হ’তে পারে যখন মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত নীতিতে বিভেদ বিরাজমান?... এ দুর্বলতাই আজ মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হ’ল যেটা আমি আগেই বলেছি, বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে যথাযথভাবে ফিরে আসা এবং সমাজে তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহর নীতি বাস্তবায়ন করা। আশা করি এটুকুই যথেষ্ট হবে। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার হাদিসের নামে জালিয়াতি বইতে বলেন,

হাদীসের নামে মিথ্যা বলার একটি প্রকরণ হলো, অনুবাদের ক্ষেত্রে শাব্দিক অনুবাদ না করে অনুবাদের সাথে নিজের মনমত কিছু সংযোগ করা বা কিছু বাদ দিয়ে অনুবাদ করা। অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন তার ব্যাখ্যাকে হাদীসের অংশ বানিয়ে দেয়া। আমাদের সমাজে আমরা প্রায় সকলেই এ অপরাধে লিপ্ত রয়েছি। আত্মশুদ্ধি, পীর-মুরিদী, দাওয়াত-তাবলীগ, রাজনীতিসহ মতভেদীয় বিভিন্ন মাসআলা-মাসাইল-এর জন্য আমরা প্রত্যেক দলের ও মতের মানুষ কুরআন ও হাদীস থেকে দলীল প্রদান করি। এরূপ দলীল প্রদান খুবই স্বাভাবিক কর্ম ও ঈমানের দাবি। তবে সাধারণত আমরা আমাদের এ ব্যাখ্যাকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে চালাই। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, কিন্তু প্রচলিত অর্থে ‘দলীয় রাজনীতি’ করেন নি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের মত কিছু করেন নি। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ‘রাজনীতি’ করছেন অনেক আলিম। ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ বা ইকামতে দীনের একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে একে গ্রহণ করা হয়। তবে যদি আমরা বলি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাজনীতি করেছেন’, তবে শ্রোতা বা পাঠক ‘রাজনীতি’র প্রচলিত অর্থ, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কথাই বুঝবেন। আর এ রাজনীতি তিনি করেন নি। ফলে এভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। এজন্য আমাদের উচিত তিনি কী করেছেন ও বলেছেন এবং আমরা কি ব্যাখ্যা করছি তা পৃথকভাবে বলা। রাসূলুল্লাহ ﷺ দীন প্রচার করেছেন আজীবন। দীনের জন্য তিনি ও তাঁর অনেক সাহাবী চিরতরে বাড়িঘর ছেড়ে ‘হিজরত’ করেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই দাওয়াতের জন্য সময় নির্ধারণ করে ২/১ মাসের জন্য সফরে ‘বাহির’ হন নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে হিজরত না করলেও অন্তত কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন স্থানে যেয়ে দাওয়াতের কাজ করছেন। কিন্তু আমরা এ কর্মের জন্য যদি বলি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ দাওয়াতের জন্য ‘বাহির’ হতেন, তবে পাঠক বা শ্রোতা ‘নির্ধারিত সময়ের জন্য বাহির হওয়া’ বুঝবেন। অথচ তিনি কখনোই এভাবে দাওয়াতের কাজ করেন নি। এতে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে।

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সুফি-সালাফি(ওহাবী) সম্পর্ক, তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও পশ্চিমা বিশ্বে তার অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপারে তার ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বইতে বলেন,

‘ওহাবী মতবাদ’-কে জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে অনেক গবেষক উল্লেখ করছেন। সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (১৭০৩-১৭৯২ খৃ) প্রচারিত মতবাদকে ‘ওহাবী’ মতবাদ বলা হয়। তিনি তৎকালীন আরবে প্রচলিত কবর পুজা, কবরে সাজদা করা, কবরে বা গাছে সুতা বেঁধে রাখা, মানত করা ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার, শিরক, বিদ‘আত ইত্যাদির প্রতিবাদ করেন। তাঁর বক্তব্য শুধু প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উপরন্তু তাঁর বিরোধীদের তিনি মুশরিক বলে অভিহিত করতেন। ১৭৪৫ খৃস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের অনতিদূরে অবস্থিত দিরইয়া্য নামক ছোট্ট গ্রাম-রাজ্যের শাসক আমীর মুহাম্মাদ ইবনু সাঊদ (মৃত্যু ১৭৬৫) তাঁর সাথে যোগ দেন। তাদের অনুসারীরা তাদের বিরোধীদেরকে মুশরিক বলে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালন শুরু করেন। ১৮০৪ সালের মধ্যে মক্কা-হিজায সহ আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ ‘সাউদী’- ‘ওহাবী’দের অধীনে চলে আসে। তৎকালীন তুর্কী খিলাফত এ নতুন রাজত্বকে তার আধিপত্য ও নেতৃত্বের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন। কারণ একদিকে মক্কা-মদীনা সহ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, অন্যদিকে মূল আরবে স্বাধীন রাজ্যের উত্থান মুসলিম বিশ্বে তুর্কীদের একচ্ছত্র নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তুর্কী খলীফা দরবারের আলিমগণের মাধ্যমে ওহাবীদেরকে ধর্মদ্রোহী, কাফির ও ইসলামের অন্যতম শত্রু হিসেবে ফাতওয়া প্রচার করেন। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারাভিযান চালানো হয়, যেন কেউ এ নব্য রাজত্বকে ইসলামী খিলাফতের স্থলাভিষিক্ত মনে না করে। পাশাপাশি তিনি তুর্কী নিয়ন্ত্রণাধীন মিসরের শাসক মুহাম্মাদ আলীকে ওহাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন। মিশরীয় বাহিনীর অভিযানের মুখে ১৮১৮ সালে সউদী রাজত্বের পতন ঘটে। এরপর সাউদী রাজবংশের উত্তর পুরুষেরা বারংবার নিজেদের রাজত্ব উদ্ধারের চেষ্টা করেন। সর্বশেষ এ বংশের ‘আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুর রাহমান আল-সাউদ (১৮৭৯-১৯৫৩) ১৯০১ থেকে ১৯২৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বর্তমান ‘সৌদি আরর’ প্রতিষ্ঠা করেন। খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মুসলিম বিশ্বের যেখানেই সংস্কারমূলক কোনো দাওয়াত বা আহবান প্রচারিত হয়েছে, তাকেই সৌদি ‘ওহাবীগণ’ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত বলে দাবি করেছেন। অপরদিকে তুর্কী প্রচারণায় ‘ওহাবী’ শব্দটি মুসলিম সমাজে অত্যন্ত ঘৃণ্য শব্দে পরিণত হয়। তাদেরকে অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের চেয়েও অধিকতর ঘৃণা করা হয়। ফলে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বৃটিশ বিরোধী আলিমদেরকে ওহাবী বলে প্রচার করতেন; যেন সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকে। এছাড়া মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরকে নিন্দা করার জন্য ‘ওহাবী’ শব্দের ব্যাপক ব্যাবহার করেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের সমসাময়িক ভারতীয় মুসলিম সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (১৭০৩-১৭৬২ খৃ)। তাঁর মত-প্রচারের প্রথম দিকে ১৭৩১ খৃস্টাব্দে তিনি মক্কায় গমন করেন এবং তিন বৎসর তথায় অবস্থান করেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি ভারতে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনিও কবর পূজা, পীর পূজা, কবরে মানত করা, কবরবাসী বা জীবিত পীর বা ওলীগণের কাছে বিপদমুক্তির সাহায্য চাওয়া ও অন্যান্য শিরক, বিদ‘আত, কুসংস্কার, মাযহাবী বাড়াবাড়ি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘ওহাবী’ বলে চিহ্নিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তবে ভারতের সর্বপ্রথম সংবিধিবদ্ধ ও সুপ্রসিদ্ধ ‘ওহাবী’ নেতা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীযের (১৩৪৬-১৮২৩ খৃ) অন্যতম ছাত্র সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (১৭৮৬-১৮৩১ খৃ)। তিনি সমগ্র ভারতে মাযার, দরগা, ব্যক্তি পূজা, মৃত মানুষদের নামে মানত, শিন্নি ইত্যাদি বিভিন্ন শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। এছাড়া তিনি বৃটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৮২১ খৃস্টাব্দে তিনি হজ্জে গমন করেন। প্রায় তিন বৎসর তথায় অবস্থানের পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৮২৬ খৃস্টাব্দে তিনি বৃটিশ ভারত থেকে ‘হিজরত’ করে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গমন করে সেখানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং নিজে সেই রাষ্ট্রের প্রধান হন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম সেখানে একত্রিত হয়ে বৃটিশ ও শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। কয়েকটি যুদ্ধের পরে ১৮৩১ খৃস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে তাঁর বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিনি শাহাদত বরণ করেন। পরবর্তী প্রায় ৩০ বৎসর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অনুসারীগণ বৃটিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার বিচ্ছিন্ন জিহাদ ও প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ১৮০৩-৪ সালে ‘‘ওহাবী’’-গণ মক্কা-মদীনা দখল করে এবং তথাকার প্রচাীন মাজার-কেন্দ্রিক সৌধগুলি ভেঙ্গে ফেলে। এতে সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর অনুসারীগণ ‘‘ওহাবী’’-দের মতই একইভাবে শিরক, কুফর, বিদ‘আত, কুসংস্কার ইত্যাদির প্রতিবাদ করতেন। এভাবে তাদের মতামতের সাথে ‘‘ওহাবী’’-দের মতামতের বাহ্যিক সাদৃশ্য ছিল। ১৮২৩ খৃস্টাব্দে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় গমন করেন। ইংরেজ শাসকগণ সুকৌশলে প্রচার করে যে, ‘স্বাধীনতার নামে যারা আপনাদের ধর্মের বাণী শোনাচ্ছে আসলে তারা ইসলামের শত্রু এবং নবী ও সাহাবাদের অপমানকারী দল, এদের নাম ওহাবী, এরাই আপনাদের প্রিয় রাসুলের (সাঃ) বংশধরদের কবরগুলি ধ্বংস করে দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে ... আর সৈয়দ আহমদ তাদেরই এজেন্ট নিযুক্ত হয়েছে এবং এরা সবাই ওহাবী তাই এরাও আপনাদের শ্রদ্ধেয় পীরবুজুর্গ ও পুর্বপুরুষদের কবর ভাঙ্গতে চায়...। এভাবে বৃটিশ সরকার বুঝান যে, প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ক্ষোভ নেই। প্রকৃত ইসলাম ও মুসলিমদেরকে তাঁরা খুবই ভালবাসেন। শুধু বিভ্রান্ত ওহাবী সম্প্রদায়ের মানুষদেরকেই তারা দমন করছেন ও শাস্তি দিচ্ছেন। কাজেই এতে সাধারণ ভাল মুসলিমরেদ বিরক্ত হওয়ার বা কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর শিষ্যদের থেকে ভারতে বিভিন্ন সংস্কারমুখী ধারার জন্ম নেয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্য থেকে অনেকে নির্ধারিত মাযহাব অনুসরণ অস্বীকার করে নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ বলে দাবি করেন। তাঁর শিষ্য জৌনপূরের পীর মাওলানা কারামত আলী একটি সংস্কারমুখী ধারার জন্ম দেন। ফুরফুরার পীর মাওলানা আবূ বাক্র সিদ্দীকীও সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর মতানুসারী ও তাঁর প্র-শিষ্য ছিলেন। দেওবন্দী আলিমগণও তাঁরই শিষ্যদের থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। এদেরর সকলকেই প্রতিপক্ষগণ ও ঔপনিবেশিক সরকার ‘ওহাবী’, ‘‘রঙিন ওহাবী’’ বা ‘‘বর্ণচোরা ওহাবী’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অন্যতম শিষ্য ও সমসাময়িক সংস্কারক মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমির (১৭৮২-১৮৩১) এবং সমকালীন অন্য সংস্কারক হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)। এদেরকেও ওহাবী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এদের আন্দোলন ও প্রতিরোধকে ওহাবী আন্দোলন বলা হয়েছে। ‘‘ওহাবী’’ শব্দের ব্যবহার বুঝতে একটি উদাহরণ পেশ করছি। মীর নিসার আলী ওরফে তীতু মীর ১৭৮২ খৃস্টাব্দে বাংলার ২৪ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮২৩ সালে হজ্জের সময় মক্কায় সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। তিনি তাঁর মুরীদ হন। দেশে ফিরে তিনি তাঁর এলাকার মানুষদের মধ্যে বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা প্রচার করেন। তিনি বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বললেও কখনোই হিন্দু ধর্ম, ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে কিছুই বলেন নি। কিন্তু তাঁর শিক্ষায় সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ধর্মপালন বৃদ্ধি পাওয়াতে এলাকার হিন্দু জমিদারগণ ক্ষুদ্ধ হন। তাঁরা সাধারণ মুসলিম প্রজাদেরকে জানান যে, প্রকৃত ইসলামকে তাঁরা খুবই ভালবাসেন। তবে ওহাবী মতবাদকে তারা দমন করতে চান। যুগযুগ ধরে মুসলিমগণ হিন্দুদের মতই নাম রেখেছেন, দাড়ি কেটেছেন, গোঁফ রেখেছেন, মসজিদ বানানোর জন্য ব্যস্ত হন নি এবং গোহত্যা করেন নি। তীতুমীর ওহাবী মতানুসারে দাড়ি রাখতে, গোঁফ কাটতে, মুসলমানী নাম রাখতে, মুসলমানদের গ্রামে মসজিদ বানাতে ও কুরবানীর নামে গোহাত্যা করতে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। এজন্য ওহাবী মতবাদ দমন করা অতীব জরুরী। এদের দমনের কারণে ‘‘ভাল’’ মুসলমানদের বিক্ষুদ্ধ হওয়ার বা কষ্ট পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। এজন্য তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ন বাবু, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, নগরপুরের জমিদার গৌড়প্রসাদ চৌধুরী ও অন্যান্য প্রখ্যাত জমিদার সমবেতভাবে ৫টি বিষয়ে নোটিশ জারি করেন: ‘‘(১) যাহারা তীতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া ওহাবী হইবে, দাড়ি রাখিবে, গোঁফ ছাটিবে, তাদের প্রত্যেককে ফি দাড়ির উপর আড়াই টাকা এবং ফি গোঁফের উপর পাঁচ সিকা খাজনা দিতে হইবে। (২) মসজিদ প্রস্ত্তত করিলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক সহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হইবে। (৩) পিতা-পিতামহ বা আত্মীয়- স্বজন সন্তানের যে নাম রাখিবে সে নাম পরিবর্তন করিয়া ওহাবী মতে আরবী নাম রাখিলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হইবে। (৪) গোহত্যা করিলে হত্যাকারীর দক্ষিণ হস্ত কাটিয়া নেওয়া হইবে, যেন সে ব্যক্তি আর গোহত্যা করিতো না পারে। (৫) যে ব্যক্তি ওহাবী তীতুমীরকে নিজ বাড়ীতে স্থান দিবে তাহাকে তাহার ভিটা হইতে উচ্ছেদ করা হইবে।’' বস্ত্তত, তুর্কী খিলাফাত ও বৃটিশ সরকারের ব্যাপক প্রচারের কারণে ‘‘প্রকৃত ইসলাম’’ ও ‘‘ওহাবী ইসলামের’’ এ বিভাজন পাশ্চাত্য গবেষকদের কাছে সার্বজনীনতার রূপ পেয়েছে। বিশ্বের যে কোনো স্থানে সংস্কার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, উপনিবেশ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বা পাশ্চাত্য বিরোধী আন্দোলনে ধার্মিক মুসলিম, আলিম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা পীর-মাশাইখের সম্পৃক্ততা থাকলেই তাকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। ওহাবী ইসলাম ও প্রকৃত ইসলামের এ বিভাজনের ক্ষেত্রে অনেক পাশ্চাত্য গবেষক প্রকৃত ইসলামকে ‘‘সূফী ইসলাম’’ বলে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে, সূফী ইসলাম অসাম্প্রদায়িক, অরাজনৈতিক ও উদার। প্রমাণ হিসেবে তারা বলেন যে, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার মুসলিম ও অমুসলিম সমাজের অগণিত সূফী দরবারে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষ একত্রিত হচ্ছেন, যিক্র, ওযীফা, সামা-কাওয়ালী ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন এবং তবারুক ও দুআ গ্রহণ করছেন। এ সকল দরবারে আত্মশুদ্ধি ও আধ্ম্যাত্যিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি আলোচনা করা হয় না। আমাদের দেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা সূফী ইসলামের দুটি পর্যায় দেখতে পাই। আমরা দেখি যে, অনেক মুসলিম তাসাউফ ও সূফীবাদের নামে পীর-মাশাইখকে আল্লাহর অবতার বা বিশেষ ‘‘ঐশ্বরিক’’ সম্পর্ক বা ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করেন, তাদেরকে সাজদা করেন, তাদের কবর-মাযার বা সমাধি সাজদা করেন, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি শরীয়তের আহকাম পালনকে গুরুত্বহীন মনে করেন এবং গান-বাজনা ও নৃত্যগীতিকে সূফী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে গণ্য করেন। এরা নিজেদেরকে প্রকৃত সূফী ও প্রকৃত সুন্নী বলে দাবি করেন। যারা পীর সাজদা, করব সাজদা, গানবাজনা, ধুমপান ইত্যাদির প্রতি আপত্তি প্রকাশ করেন বা শরীয়ত পালনের বাধ্যবাধকতার কথা বলেন তাদেরকে এ পর্যায়ের সূফীগণ ‘‘ওহাবী’’ এবং ‘‘ওলীগণের দুশমন’’ বলে কঠোরভাবে নিন্দা করেন। অনেকে তামাক, গাজা ইত্যাদি সেবন বা ধুমপানকে সুন্নী ইসলাম ও সূফী ইসলামের মৌলিক পরিচয় বলে গণ্য করেন এবং ধুমপান বিরোধীদেরকে ওহাবী ও ওলীগণের দুশমন বলে নিন্দা করেন। অন্য অনেক মুসলিম পীর-সাজদা, করব-সাজদা, গান-বাজনা ইত্যাদি কর্মকে কঠিনভাবে নিন্দা করেন, শরীয়ত প্রতিপালনকে সূফী ইসলামের মূল বিষয় বলে গণ্য করেন এবং শরীয়ত প্রতিপালনের পাশাপাশি পীর-মাশাইখের নিকট তরীকত শিক্ষা করেন ও পালন করেন। প্রথম পর্যায়ের সুফী ও মারফতীগণের মতানুসারে এরা ওহাবী ও সূফী ইসলামের দুশমন। তবে এরা নিজেদেরকে প্রকৃত সূফী ও সুন্নী বলে দাবি করেন এবং প্রথম পর্যায়ের মানুষদেরকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন। এ পর্যায়ের তাসাউফ-পন্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ওরস, ঈসালে সাওয়াব, মীলাদুন্নবী, সীরাতুন্নবী, যিকরের পদ্ধতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এ পর্যায়ের সূফীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ সকল মতভেদের ভিত্তিতে এ পর্যায়ের সূফীগণের একদল আরেকদলকে ওহাবী, নবীর দুশমন বা ওলীগণের দুশমন বলে নিন্দা করেন এবং নিজেদেরকে প্রকৃত সুন্নী ও প্রকৃত সূফী বলে দাবি করেন, যদিও সকলেই পীর-মুরিদী ও তাসাউফে বিশ্বাস করেন ও বিভিন্ন তরীকা অনুসরণ করেন। পাশ্চাত্যের খৃস্টানগণ প্রকৃতিগতভাবেই প্রথম পর্যায়ের সূফী ইসলাম ও এর অনুসারীদের ভালবাসেন। কারণ তাদের ‘‘মানসিকতার’’ সাথে এদের ‘‘মানসিকতার’’ খুবই মিল। ইউরোপ-আমেরিকা ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশে এরূপ সূফীদের মাজলিস- দরবার ও খানকা-মাজারে তারা আগমন করেন, গান-বাজনা ও আধ্ম্যাতিক চর্চায় অংশ নেন। এ সকল সূফীও এদেরকে অত্যন্ত ভালবেসে গ্রহণ করেন। স্বভাবতই পাশ্চাত্যের মানুষেরা বিশ্বের সকল মুসলিম দেশে এরূপ সূফী ইসলামের প্রসার কামনা করেন। এরূপ সূফী ইসলামের প্রসারই সকল ধর্মের ও ধর্মহীন মানুষদের মধ্যে অনাবিল শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে বলে তারা বিশ্বাস করেন। ‘‘সভ্যতার সংঘাতের’’ নামে ইসলামী দেশগুলিতে আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রথমে ঢালাওভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কিন্তু তারা দেখেন যে, এতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ছে। তখন তারা মুসলমানদেরকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে কাউকে পক্ষে ও কাউকে বিপক্ষে নিতে চান। এজন্য প্রথমে তারা লিবারেল (liberal) বা উদার ও (fundamentalist) অর্থাৎ মৌলবাদী বা কট্টরপন্থী বলে ভাগাভাগি করেন। এরূপ ভাগাভাগি মুসলিম দেশগুলিতে তেমন কোনো বাজার লাভ করে না। এজন্য বিগত কয়েক বছর যাবত তারা নতুন একটি ভাগাভাগি বাজারজাত করতে চেষ্টা করছেন, তা হলো সূফী ইসলাম ও ওহাবী ইসলাম। মুসলিম দেশগুলিতে সূফীগণের প্রভাব ও ‘‘ওহাবী’’ শব্দটির প্রতি মুসলিমদের ঘৃণার বিষয়টি তারা জানেন। বৃটিশ সরকার ও হিন্দু জমিদারগণ যেভাবে সাইয়েদ আহমদ, তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ ও অন্যান্য সকল ধর্মীয় সংস্কার ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিত্রিত করে সাধারণ মুসলিমদের কাছে ঘৃণিত করার চেষ্ঠায় অনেকটা সফলতা লাভ করেছিলেন, তেমনি তারা তাদের স্বার্থের সাথে সাংঘষিক সকল ইসলামী কর্মকান্ড ও ব্যক্তিত্বকে ‘‘ওহাবী’’ রূপে চিত্রিত করতে চেষ্টা করছেন। অন্তত সুন্নীওহাবী বা সূফী-ওহাবী বিতর্ক ও সঙ্ঘাত উস্কে দিতে পারলে ইসলামী দাওয়াত, শিক্ষা বিস্তার, অশ্লীলতা-মাদকতার প্রতিবাদ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আলিম বা ইসলামপন্থীদের উত্থান নিশ্চিতরূপেই ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হবে।তারা মূলত সূফী ইসলাম বলতে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বুঝছেন। কারণ, দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীদের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রমুখের মত ব্যক্তিত্বর আবির্ভাব ঘটতে পারে, যাদের ক্ষমতায়ন তাদের স্বার্থ রক্ষা করে না। তারা বিশ্বাস করেন যে, প্রথম পর্যায়ের সূফীদের উত্থানই মুসলিম মানসিকতা থেকে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করতে সক্ষম এবং এ পর্যায়ের সূফী ইসলামই বিশ্বের মানুষদেরকে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে রক্ষা করে সকল ধর্মের শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, এদের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের প্রধান দুটি ধর্ম: খৃস্টধর্ম ও ইসলামকে একেবারেই কাছাকাছি করে দিতে পারে। বস্ত্তত প্রথম পর্যায়ের সূফীগণ এবং পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীগণকে ‘‘প্রকৃত ওহাবী’’ বা ‘‘বর্ণচোরা ওহাবী’’ বলে বিশ্বাস করেন। এদের হাতে তাদের স্বার্থ নিরাপদ নয় বলেও তারা জানেন। তবে মুসলিম দেশগুলিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীগণের প্রভাব সম্পর্কেও তারা সচেতন। এজন্য তার ‘‘সূফী ইসলামের’’ নামে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের নেতৃত্বাধীনে ও তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থেকে উভয় পর্যায়ের সূফীগণকে একত্রিত করে তাদেরকে ‘‘ওহাবী’’-দের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। তারা বুঝাচ্ছেন যে, যারা ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র, বিচার, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন তারা মূলত ওলীগণের মাজারভাঙ্গা সৌদী ওহাবীগণের দালাল ও তাদের মতের অনুসারী। এরা ক্ষমতা লাভ করলে এরাও পীর-মাশাইখ ও কবর-মাজার ধ্বংস করবে। কাজেই এদেরকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। একথা নিশ্চিত যে, সাধারণ মুসলিম, আলিম ও পীর-মাশাইখ তাদের এরূপ প্রচারণায় প্রভাবিত হবেন। এছাড়া এ অযুহাতে ওহাবী-সুন্নী বির্তর্ক ও হানাহানির প্রসার ঘটিয়ে মুসলিমদেরকে সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রচারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন। বস্ত্তত ‘‘ইসলাম’’ নামের যেমন ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়েছে এবং ইসলামের নামে ইসলাম বিরোধী কর্ম করা হয়েছে ও হচ্ছে, তেমনি ‘‘সূফী’’ শব্দেরও ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়েছে। তাসাউফ, সূফী, পীর, দরবেশ ও ওলীগণের নামে অনৈসলামিক কর্মকান্ডও ঘটেছে অনেক। তবে সর্বজন স্বীকৃত সূফী-দরবেশগণের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, তাঁরা সকলেই সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। প্রায় সকল সূফী ‘‘তরীকা’’-র মূল সূত্র হিসেবে আবূ বাকর সিদ্দীক (রা) ও আলী (রা)-কে উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত অমান্যকারী, ধর্মত্যাগী, ধর্মীয় অনাচারে লিপ্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁরা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর পথিকৃতি। হাসান বসরী, ইবরাহীম আদহাম, জুনাইদ বাগদাদী, আব্দুল কাদির জীলানী, আবূ হামিদ গাযালী, মুজাদ্দিদ-ই আলফিসানী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, এমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কী, কারামত আলী জৌনপুরী, আবূ বকর সিদ্দীকী ফুরফুরাবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও অন্যান্য সকল সুপ্রসিদ্ধ সূফী-সাধক আত্মশুদ্ধি ও আধ্ম্যাত্মিকতার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন, শাসকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, কারাবরণ করেছেন বা শাহাদাত লাভ করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে এদের কর্মপদ্ধতির পার্থক্য হলো ক্ষমতায় না যেয়ে ক্ষমতাসীনদের সংশোধনের চেষ্টা করা। এরা নিজেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেন নি বরং ক্ষমতাসীনদেরকে নসীহত করেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, ন্যায়ের পক্ষে উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, জনগণকে সচেতন করেছেন, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধে শরীক হয়েছেন এবং এ সকল কর্মকান্ডে যে সকল ব্যক্তি বা দলকে অপেক্ষাকৃত ভাল বলে মনে করেছেন তাদেরকে সমর্থন করেছেন বা উৎসাহ দিয়েছেন। তথাকথিত ‘‘জঙ্গি’’ কর্মকান্ড বা উগ্রতার সাথে তাদের কর্মপদ্ধতির পার্থক্য হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কিন্তু শাস্তি বা বলপ্রয়োগের চেষ্টা না করা। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, নসীহত করেছেন, ক্ষমতাসীন ও অন্যান্য সকলকে অন্যান্য দমন করতে, প্রতিবাদ করতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কিন্তু নিজে অন্যায় দমনের নামে শক্তি প্রয়োগ করেন নি, আইন অমান্য করেন নি, আইন নিজের হাতে তুলে নেন নি এবং আইন অমান্য করার ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রকৃত সূফীগণ কখনোই সমাজ-বিমুখ বা রাজনীতি-বিমুখ ছিলেন না। ‘‘সূফী ইসলাম’’-কে সমাজ, রাষ্ট্র ও জগৎ-বিমুখ বলে চিহ্নিত করা ও সকল সংস্কার আন্দোলনকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিত্রিত করার কোনো ভিত্তি নেই। তথাকথিত ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ বা জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে উসামা বিন লাদেনের মত সৌদি বংশোদ্ভুত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন বলে শোনা যায়। সৌদি আরবের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এদের অর্থায়ন করেন বলে দাবি করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত উপমহাদেশে আহলে হাদীস ও দেওবন্দী-পদ্ধতির কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত দু-চার ব্যক্তির এর সাথে সংশি­ষ্টতার কথা শোনা যায়। এছাড়া এদের মধ্যে কবর-মাযার ইত্যাদির বিরোধিতা দেখা যায়। সর্বোপরি এরা নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য মৌখিক প্রচার ছাড়াও অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। এজন্য অনেক গবেষক মনে করেন যে, ওহাবী মতবাদের প্রসারই বর্তমান জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ। তবে লক্ষণীয় যে, উসামা বিন লাদেন-এর আন্দোলনের গোড়া পত্তন হয় সৌদি-ওহাবী রাষ্ট্রের বিরোধিতার মাধ্যমে। তার অনুসারীরা তথাকার রাজতন্ত্র, মার্কিন সৈন্য, অনাচার ইত্যাদির বিরোধিতা করেন এবং সৌদি রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের বংশধরসহ সকল সৌদি আলিম বিন লাদেনের আন্দোলন ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার। সর্বোপরি, বিভিন্ন দেশের সংস্কার বা প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত করার কোনো ভিত্তি নেই। বস্ত্তত মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব ও তাঁর আদর্শ প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করেছে তুর্কি খিলাফতের প্রচার ও বৃটিশ সরকারের সুযোগসন্ধানের কারণে। ওহাবী মতবাদ ও আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একান্তই একটি আঞ্চলিক বিষয় ছিল। অন্যান্য মুসলিম দেশের সংস্কার-প্রতিরোধ ও ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মতই ভালমন্দ মেশানো একটি বিষয়। অন্যান্য দেশে মুসলিমগণ তাদের পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুসারে অনুরূপ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। যেহেতু ওহাবীগণ ও অন্যান্য দেশের মুসলিমগণ সকলেই একই সূত্র, অর্থাৎ কুরআন, হাদীস, ইসলামী ফিক্হ ও ইসলামের ইতিহাস থেকে নিজেদের মতামত সংগ্রহ করেছেন, সেহেতু তাদের মতামত ও কর্মের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। এ জন্য সকল কৃতিত্ব মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবকে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আফগানিস্থান ও ইরাকে বিন লাদেনের মতবাদ প্রসার লাভ করেছে। আর এ দুটি দেশই ঘোর ওহাবী বিরোধী। আফগানিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী হানাফী মাযহাবের কঠোর অনুসারী, পীর মাশাইখদের ভক্ত এবং ওহাবীদের বিরোধী। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ শাসনামলে ওহাবী বা অন্য যে কোনো সংস্কারমুখী আলিম ও মতবাদকে কঠোরভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শুধুমাত্র সূফীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোরতা অবলম্বন করা হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দুই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার থেকে বুঝা যায় যে, জঙ্গিবাদের কারণ অন্য কোথাও নিহিত রয়েছে। আমরা আগেই দেখেছি যে, সন্ত্রাসীদের জাতি, ধর্ম গোত্র ইত্যাদিকে ঢালাওভাবে ‘সন্ত্রাসের’ কারণ বা চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সঠিক নয়। এতে সন্ত্রাস দমনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, কোনো, জাতি, ধর্ম বা গোত্রের সকল মানুষকে তো আর ঢালাওভাবে বিচার করা যায় না। জঙ্গিবাদের দায়িত্ব ‘ওহাবী মতবাদের’ উপর চাপানোর বড় বিপত্তি হলো, এতে সমস্যা সমাধানের পথ হারিয়ে যাবে। কেননা, সৌদি ওহাবীদের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন, কারণ জঙ্গিবাদ তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত। আর অন্য কোনো দেশের কেউ নিজেকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না, কিন্তু প্রায় সকল ধর্মীয় দলই বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত। প্রত্যেকেই দাবি করেন যে, তাঁরা সরাসরি কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও পূর্ববর্তী ইমামগণের মতের ভিত্তিতে তাদের মত ও দল গঠন করেছেন; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিজস্ব কোনো মত তারা মানেন না। এমনকি সৌদি আরবের আলিমগণ কখনোই নিজেদেরকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবকে একজন সংস্কারক হিসেবে মনে করেন এবং তাঁর সকল মতামতই কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্ববর্তী ইমামগণের থেকে গৃহীত বলে দাবি ও প্রমাণ করেন।

নুরুল ইসলাম তার প্রশ্নোত্তরে রমজান ও ঈদ বইতে বলেন,

(ঈমান ভঙ্গকারী আমলসমূহের একটি হলো...) দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় বিষয় হতে পৃথক করা। আর একথা বলা যে, ইসলামে রাজনীতি নেই। এরূপ ধারণা ও মন্তব্যও রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনাদর্শকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।

মনজুর এলাহি তার "সমাজ সংস্কারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব" বইতে "সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও সে ক্ষেত্রে সঠিক ইসলামী আকীদার ভূমিকা ও গুরুত্ব" সম্পর্কে বলেন,

মানুষ তার ব্যক্তি জীবনের সকল চাহিদা মেটানোর জন্যই সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। যে কোনো সমাজ গঠনের প্রধান লক্ষ্যই হল সে সমাজের সকল সভ্যের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ। কিন্তু ব্যক্তি জীবনের অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও স্বার্থপরতা সমাজ জীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সমাজকে দুর্নীতি, বৈষম্য, বিভক্তি, হানাহানি প্রভৃতি ব্যাধিতে কলুষিত ও বিষাক্ত করে তোলে। তখনই দেখা দেয় সমাজ সংস্কারের বিরাট প্রয়োজনীয়তা, যেমনটি আমরা অনুভব করছি আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি সমস্যা জর্জরিত দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুণে ধরা এ সমাজের মানুষের মধ্যে সঠিক আকীদার জ্ঞান নেই বললেই চলে। এরই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আকীদায় অনৈক্য এবং প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী যার যেমন ইচ্ছা তেমন আকীদা পোষণ, কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক এর যথার্থতা থাকুক বা নাই থাকুক। অন্যদিকে মানুষের ঈমান হয়ে পড়েছে অত্যন্ত দুর্বল, অন্তর থেকে তাকওয়ার বিদায় ঘটেছে, পরকালীন শাস্তির কথা সে বিস্মৃত হয়েছে। ফলে সমাজে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, লুটে-পুটে খাওয়ার প্রবণতা, নানা প্রকার সন্ত্রাস ও অপসংস্কৃতির বিস্তার ইত্যাদি আরো অনেক সমস্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাতে আমরা দেখি তিনি তৎকালীন জাহেলী সমাজকে বদলে দিয়ে একে পরিণত করেছিলেন তখনকার সর্বোৎকৃষ্ট সমাজে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের যে আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে, তার প্রাথমিক প্রক্রিয়াই ছিল আকীদাগত সংস্কার। এ সম্পর্কে সাইয়েদ কুতুব তার مقومات التصور الإسلامي (ইসলামিক উপলব্ধির উপাদান) গ্রন্থে বলেন:

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন এমন এক সময়ে যখন জাযিরাতুল আরব উত্তরে রোমান ও দক্ষিণে পারস্যের মধ্যে লুটেরা সম্পদ হিসাবে বন্টিত ছিল। এরা তাদের হাত প্রসারিত করেছিল জাযিরাতুল আরবের উর্বর ভূমি, সমুদ্রোপকুল, সম্পদ ও বাণিজ্যের সকল উৎসের প্রতি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই এক সময়ে প্রেরিত হয়েছেন যখন বিরাজমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা দাসত্ব যুগের প্রতিনিধিত্ব করত বিপুল সমারোহে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই এক সময়ে প্রেরিত হয়েছেন যখন মদ, যেনা, জুয়া, খেল-তামাশা, মন্দ ও বিপর্যয় সৃষ্টিতে মানব চরিত্র জাহেলিয়াতের ধারায় বহমান ছিল। এ সবের কোনোটি দিয়েই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংস্কার কাজ শুরু করেননি। জাযিরাতুল আরবের উর্বর ভূমি থেকে রোমান ও পারসীদের তাড়ানোর জন্য তিনি জাতীয়বাদী ঐক্যের দিকে আরবদেরকে আহ্বান করতে সক্ষম ছিলেন। যুদ্ধের সকল শক্তি তিনি তাদের ব্যাপারে নিয়োগ করতে পারতেন এবং জাতীয় শত্রুদের প্রতি তিনি আরবদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারতেন। ফলত তারা তার নেতৃত্বের প্রতি অনুগত হত এবং তাদের সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যেত।……কিন্তু আল্লাহ জানতেন, তিনি তাঁর নবীকে জানিয়েছিলেন এবং নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, এটা সঠিক পথ নয় এবং এটা মূল কাজ নয়। মূলকাজ হচ্ছে মানুষ তার সত্যিকার রবকে জানা এবং শুধু তাঁরই দাসত্ব মেনে নেওয়া, আর তাঁর বান্দাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরিশেষে আল্লাহর কাছ থেকে যা-ই তাদের কাছে আসে তার সব কিছু গ্রহণ করা….”।

...লক্ষ্যণীয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের পর মাক্কী জীবনের ১৩ বৎসরে আকীদা বিষয়ক জ্ঞান প্রচারের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নবী সা. ই শুধু নয়, বরং সকল নবী ও রাসূলগণের প্রথম কাজই ছিল সঠিক আকীদার প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আহবান। আল-কুরআনের ভাষায় তাদের সেই আহবান ছিল: “হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই।” [আল-আ‌‘রাফ: ৫৮] এর কারণ ছিল একটিই, আকীদা শুদ্ধ না হলে ব্যক্তি জীবন শুদ্ধ হয় না, আর ব্যক্তি শুদ্ধ না হলে সমাজও শুদ্ধ হয় না।

...(১) বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য স্থাপনে সঠিক আকীদার ভূমিকা: সঠিক আকীদার উপর একমত হওয়া ছাড়া বৃহত্তর ঐক্য স্থাপন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর পক্ষেও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সুদূর পরাহত। এ প্রসঙ্গে (ড.) উমার সুলায়মান আল-আশকার বলেন: “একই আকীদা যতক্ষণ মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম ঐক্য বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব না।” প্রকৃতপক্ষে আকীদাগত বিভ্রান্তিই সমাজে অনৈক্যের বীজ বপন করে। সমাজ হয়ে পড়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত। যদি প্রশ্ন উঠে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ আকীদা ও বিশ্বাসকে সঠিক বলে মনে করে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো আকীদাকে সঠিক ধরে নিয়ে একমত হওয়া সম্ভব হবে না। কারণ প্রত্যেক দল নিজ মতের প্রতি আস্থাশীল। এ প্রশ্নের উত্তরে (ড.) উমার সুলাইমান আল-আশকার বলেন: “বিশুদ্ধ ইসলামী আকীদা বিষয়ে কুরআন ও সুন্নায় স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এ আকীদার প্রতিটি মৌলিক ও খুটিঁনাটি বিষয়ে দলীল পেশ করা সম্ভব। আর সালাফে সালেহীন সত্য ইসলামী আকীদার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারা এ আকীদা এতটাই ভালোভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, তা ফেরকাবাজী ও বিভ্রান্ত লোকদের আকীদা থেকে পুরোপুরি পৃথক। এ মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ত্বহাবী, যিনি একটি আকীদা গ্রন্থ লিখেন যা তার নিজের নামেই বিখ্যাত। এ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেছেন মুহাম্মাদ ইবন আবিল ইয্ আল-হানাফী। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি, বরং সহীহ আকীদার উপর বহু আলেম এর আগে ও পরে লিখেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ, ইবনু তাইমিয়াহ, শওকানী ও সাফারীনী প্রমুখ।”

(২) দুর্নীতি, রাহাজানি, যুলুম-নির্যাতনমুক্ত সুশীল সমাজ গঠনে সঠিক আকীদা এমন একটি মজবুত ভিত তৈরী করে।যার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় সমাজের সকল কাজ-কর্ম, পারস্পরিক লেন-দেন। অতএব আকীদা যদি হয় বিকৃত বিভ্রান্ত ও মিথ্যার উপর স্থাপিত, তাহলে সামাজিক জীবন হয়ে পড়বে বিপন্ন, বিপর্যস্ত ও ধ্বংসের মুখোমুখী। আজ আমাদের সমাজ যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ মূলত এটাই। সুতরাং সমাজকে বিকৃতি, বিপর্যয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সঠিক আকীদার দিকেই ফিরে আসতে হবে।

(৩) সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সঠিক আকীদায় গুরুত্ব: একজন মুসলিম ব্যক্তির আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই যে, সে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাকে অপরিহার্য মনে করে এবং তাদের হুকুমের নাফরমানী করা অবৈধ বলে বিশ্বাস করে। আল্লাহ বলেন: “আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না।” [আল-আহযাব: ৩৬] সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসলিমদেরকে পরস্পরের ভাই বলে অভিহিত করেন, কোনো ব্যক্তির জান ও মালের উপর চড়াও হওয়াকে গুরুতর অপরাধ বলে সনাক্ত করেন, চুক্তিবদ্ধ সকল অমুসলিমের সাথে কৃত চুক্তি পালনের নির্দেশ প্রদান করেন, সে তখন দ্বিধাহীন চিত্তে সে নির্দেশ মেনে নেয়, কেননা এভাবে মেনে নেয়াটা তার আকীদারই অংশ। আল্লাহ বলেন: “অতএব তোমাদের রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।” [আন-নিসা: ৬৫]

(৪) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: ইসলামী আকীদার অপরিহার্য একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে দৃঢ় ঈমান রাখা যে, আল্লাহ যেমন এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টি কর্তা, তেমনি তিনিই এর শাসন-কর্তৃত্ব ও নির্দেশের মালিক। আল্লাহ বলেন: “জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই।” [আল-আ‌রাফ: ৫৪] “বল, নিশ্চয় সব বিষয় আল্লাহর।” [আলে ইমরান: ১৫৪] “হুকুম তো কেবল আল্লাহরই।” [আল-আন‘আম: ৫৭] এছাড়া আল্লাহই সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং একমাত্র আইনদাতা ও বিধানদাতা। এটা তাকে রব হিসাবে মেনে নেয়ারই অন্যতম অর্থ। আমাদের সমাজে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তখনই ফিরে আসতে পারে যখন এ আকীদার প্রতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃঢ় প্রত্যয় থাকবে। মূলত মানব রচিত আইন দিয়ে কোনো মুসলিম সমাজেই শান্তি, শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। সম্ভবত বাস্তবতাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ও সাক্ষী।

(৫) অপসংস্কৃতি রোধে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: বিজাতীয় ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্মের অনুকরণে আমাদের বাংলাদেশী সমাজে সংস্কৃতির নামে বর্তমানে যে সব কিছুর চর্চা হচ্ছে, তাকে অপসংস্কৃতি নামে অভিহিত করলে বোধকরি কোনো অত্যুক্তি হবে না। কেননা এসব সংস্কৃতি যেমনি আমাদের দেশীয় চিন্তা-চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি তা মুসলিম আকীদার সাথে বহুলাংশেই সাংঘর্ষিক। স্মরণ রাখতে হবে আমাদের এ দেশটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই যদি আমরা আমাদের সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানকে সঠিক ইসলামী আকীদার আলোকে বিন্যস্ত করি, তাহলেই দেশ উপহার পেতে পারে একটি সুন্দর, রুচিশীল, শালীন ও সুস্থ-সংস্কৃতি।

(৬) চিন্তার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি এবং শির্ক ও বেদ‘আত থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যাপারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: সঠিক ইসলামী আকীদার জ্ঞানই পারে সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর চিন্তা জগতকে আলোকিত করতে যা দিয়ে তারা জাতিকে দিতে পারবেন সত্য পথের দিশা। আজ একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবিদের চিন্তার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি আমরা লক্ষ্য করছি, মুসলিম নামধারী হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরুদ্ধে তারা যে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ এই যে, ইসলামকে তারা বিকৃতভাবে জেনেছেন, সঠিক ইসলামী আকীদা অর্জনের সৌভাগ্য তাদের হয় নি। একই কথা প্রযোজ্য সে সকল শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুসলিমদের ক্ষেত্রেও যারা ইবাদাত মনে করে শির্ক ও বেদ‘আতের মধ্যে নিমজ্জিত। কুরআন ও সুন্নার আলোকে তারা শির্ক ও বেদ‘আতের পরিচয় পায় নি। শির্ক ও বেদ‘আতকে চেনার যে সকল মূলনীতি রয়েছে তারা সেসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল। সঠিক আকীদার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আকীদার জ্ঞান অর্জনই নিশ্চয়তা দিতে পারে এসব বিভ্রান্তি এবং শির্ক ও বেদ‘আত থেকে সমাজের সবাইকে মুক্ত করার।

অতএব সহীহ ইসলামী আকীদার জ্ঞান অর্জনই আল্লাহর প্রকৃত মু’মিন ও মুসলিম বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার একমাত্র পন্থা। অনুরূপভাবে একটি সমাজকে পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ রূপে গড়ে তুলতে চাইলে সমাজের সকলকে সহীহ আকীদার জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইসলামী সংগঠনগুলোকে গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইসলামী শরীয়াহ ও স্টাডিজের উপর যারা দক্ষ তারা সহীহ আকিদা বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করে এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত বইয়ের যে অপ্রতুলতা রয়েছে তা দূর করতে পারেন। এ ব্যাপারে মসজিদের ইমাম, খতিব ও মাদরাসা শিক্ষকদের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য তার আগে তাদেরকে সহীহ আকিদার জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে। সহীহ আকিদা প্রসারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এভাবে আমাদের সমাজ গড়ে ওঠতে পারে শির্ক ও বেদ‘আতমুক্ত একটি সুন্দর সুশীল সমাজ হিসাবে।

মুশ্তাক আহমেদ কারীমী ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাংকের সুদের সাথে রাজনীতির সম্পর্কের ব্যাপারে বলেন,

ব্যাংক এবং অনুরূপ কোন সংস্থা নিছক অর্থপূজা, ব্যবসা ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার, সুবিধা ভোগ এবং অর্থ শোষণ করার অভিপ্রায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যে এই থাকে যে, সূদের লোভ দেখিয়ে জনগণ ও জাতির ধন-মাল যতবেশী আকারে সম্ভব নিজেদের আয়ত্তে আনা হবে এবং এই পদ্ধতিতে নিতান্ত চাতুর্যের সাথে সমগ্র জাতির উপর স্বীয় ক্ষমতা ও শাসন চালানো হবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে দুর্ভিক্ষ আনা যাবে এবং যেখানে ইচ্ছা সেখানে অনাহার সৃষ্টি করে বিনাশ আনয়ন করা হবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিজের পছন্দমত শাসন ও রাজনীতি প্রয়োগ করা যাবে। যখন ইচ্ছা তখন মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করা সম্ভব হবে এবং যখন ইচ্ছা তখন মুদ্রামান বর্ধিত করে মার্কেটে ব্যাপক আকারে মন্দা ছড়ানো যাবে। যাকে ইচ্ছা গদিচ্যুত এবং যাকে ইচ্ছা তাকে গদীনশীন করা সহজ হবে।

ইতিহাস

প্রাথমিক যুগ

রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে ইসলামের ভিত্তি ইসলামিক নবী মুহাম্মদ এবং তার উত্তরসূরিদের জীবন ও সময়গুলিতে খুঁজে পাওয়া যায়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে নিজ নবুয়াতের দাবির স্বীকৃতি হিসাবে মুহাম্মদকে মদীনা শহরে শাসন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ সময় আউস এবং খাজরাজ গোত্রের স্থানীয় আরব উপজাতিরা এই শহরটিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং তাতে নিয়মিত সংঘাত সংঘর্ষ চলমান ছিল। মদিনার অধিবাসীরা মুহাম্মাদের মাঝে একজন নিরপেক্ষ বহিরাগত দেখতে পেয়েছিল যে সংঘাতটি সমাধান করতে পারে। মুহাম্মদ এবং তাঁর অনুসারীরা এভাবে মদিনায় চলে যায়, যেখানে মুহাম্মদ মদীনার সনদ খসড়া করেছিলেন। এই দলিলটি মুহাম্মদ কে শাসক হিসেবে পরিণত করে এবং তাকে আল্লাহর নবী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। মুহম্মদ তাঁর শাসনকালে কুরআন ও নিজ কর্মের উপর ভিত্তি করে আইন প্রতিষ্ঠা করে, যাকে মুসলমানরা শরিয়া বা ইসলামী আইন হিসাবে বিবেচনা করে, যাকে বর্তমান সময়ের ইসলামী আন্দোলনগুলো প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। মুহাম্মদ একটি বিস্তৃত অনুসারী দল ও সেনাবাহিনী অর্জন করেছিলেন এবং কূটনীতি ও সামরিক বিজয়ের সংমিশ্রণের মাধ্যমে তার শাসন প্রথমে মক্কা শহরে এবং এরপর আরব উপদ্বীপের মাধ্যমে প্রসারিত হয়।

বর্তমানে বহু সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামপন্থী বা ইসলামী গণতান্ত্রিক দল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিদ্যমান। অনেক জঙ্গি ইসলামী গোষ্ঠীও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। পাশাপাশি কিছু অমুসলিম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতিপয় জঙ্গিবাদী ইসলামী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শনের বর্ণনা দেওয়ার জন্য "ইসলামি মৌলবাদ" নামক একটি বিতর্কিত শব্দের উদ্ভাবন করেছেন। এই উভয় পরিভাষাই (ইসলামী গণতন্ত্র এবং ইসলামী মৌলবাদ) পৃথক ইতিহাস, মতাদর্শ এবং দৃষ্টিকোণের অধিকারী বিভিন্ন দল-উপদলের এক বিশাল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।

মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র

ইসলামী নবী মুহাম্মাদ মদিনার সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিলেন। এতে মুহাম্মাদ ও ইয়াস্রিবের (পরবর্তীতে মদিনা) সকল গুরুত্বপূর্ণ গোত্র ও পরিবারের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি বিধিবদ্ধ হয়েছিল, যার মধ্যে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সংবিধান প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের মূলভিত্তি গঠন করেছিল। এই দস্তাবেজটি মদিনার আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে চলমান তিক্ত আন্তঃগোত্রীয় লড়াইয়ের একটি আশানুরূপ সমাপ্তি আনয়নের প্রকাশ্য প্রচেষ্টাস্বরূপ লিখিত হয়েছিল। এতে মদিনার মুসলিম, ইহুদি খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক সম্প্রদায়সমূহের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ সংক্ষেপে নির্ধারণ করার মাধ্যমে তাদেরকে উম্মত নামক একক সম্প্রদায়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়।


প্রাথমিক খিলাফত ও রাজনৈতিক আদর্শ

মুহাম্মদের মৃত্যুর পর, তার সম্প্রদায়ের একজন নতুন নেতা নিয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে, যার ফলে খলিফা পদবির উৎপত্তি ঘটে, যার অর্থ হল "উত্তরসূরি"। একারণে, পরবর্তীকালে ইসলামী সাম্রাজ্যগুলো খিলাফত নামে পরিচিত ছিল। উমাইয়া সাম্রাজ্য বেড়ে ওঠার সময় ইসলামের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিকাশ ছিল সুন্নি এবং শিয়া মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি; খেলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধের জেরে এই বিভাজনের সূত্রপাত ঘটেছিল। সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করতেন যে, খিলাফত হবে নির্বাচনভিত্তিক এবং যে কোন মুসলিম যোগ্যতাভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে এই পদবির অধিকারী হতে পারে। অন্যদিকে শিয়াগণ বিশ্বাস করতেন যে, খলীফাগণ নবীর বংশধরদের মধ্য থেকে হওয়া উচিত এবং এ কারণে তাদের মতে, আলী ছাড়া বাদবাকি সমস্ত খলিফা ছিলেন খলিফা পদবির অবৈধ দখলদার। তবে, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই সুন্নি সম্প্রদায় বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং একইভাবে আধুনিক ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহের (ইরান ছাড়া) অধিকাংশই সুন্নি চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।


নির্বাচন বা সরাসরি নিয়োগ

শাফেয়ী মাজহাবের মুসলিম ফকীহ আল-মাওয়ারদী লিখেছেন যে, খলিফা হওয়া উচিত কুরাইশ বংশীয়। আশআরী ইসলামী পণ্ডিত ও মালিকি আইনবিদ আবু বকর আল বাকিলনি, লিখেছেন যে, মুসলমানদের নেতা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে থেকে হওয়া উচিত। সুন্নি হানাফি ফিকহের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা আন-নুমান লিখেছেন যে, নেতা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে হতে হবে।


মজলিশ আশ-শূরা

খেলাফতের আইনসভা, সর্বাধিক উল্লেখযোগ্যভাবে রাশিদুন খিলাফতের আইনসভা আধুনিক বিবেচনায় গণতান্ত্রিক ছিল না, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা মোহাম্মদের উল্লেখযোগ্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের (সাহাবীদের) এবং বিভিন্ন গোত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিষদের হাতে ন্যাস্ত ছিল (তাদের বেশিরভাগই ছিল নিজ গোত্রের নির্বাচিত বা বাছাইকৃত ব্যক্তি)।


ক্ষমতার পৃথকীকরণ

প্রথমদিকের ইসলামি খেলাফতে, মুহাম্মদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একজন উত্তরসূরি হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধান আকারে খলিফাগণের অবস্থান তৈরি হয়েছিল , যারা সুন্নী অনুসারে জনগণ বা তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা আদর্শ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হতেন, যেমনটি আবু বকরের নির্বাচন, উসমানের নির্বাচন এবং খলিফা হিসাবে আলির ক্ষেত্রে হয়েছিল। পরে রশিদুন খালিফাদের পর ইসলামিক স্বর্ণযুগের খলিফাদের সময়ে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পরিমাণ অনেক কম ছিল, কিন্তু যেহেতু ইসলামে "ধর্মপরায়ণতা ও পুণ্যের ভিত্তি ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে কেউ কারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয় ", এবং মুহাম্মদের আদর্শ ছিল জনগণের সঙ্গে সলাপরামর্শ করা, তাই পরবর্তীকালে ইসলামী শাসকরা প্রায়শই তাদের রাজকার্যের বিষয়ে জনগণের সাথেপরামর্শ করতেন।


রাজতন্ত্র

ইসলামি রাজতন্ত্র হল একটি রাজতন্ত্র যা ইসলাম মেনে চলে। ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন মামলাকাত ("রাজ্য"), খিলাফত, সালতানাত, বা আমিরাত, বর্তমান ইসলামী রাজতন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • বাহরাইন রাজ্য
  • ব্রুনাই দারুসসালাম
  • জর্ডানের হাশেমী রাজ্য
  • কুয়েত রাজ্য
  • মালয়েশিয়া
  • মরক্কো রাজ্য
  • ওমানের সালতানাত
  • কাতার রাজ্য
  • সৌদি আরব রাজ্য
  • সংযুক্ত আরব আমিরাত

আনুগত্য ও বিরোধিতা

পণ্ডিত মোজান মোমেনের বক্তব্যমতে, "কুরআনের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় যা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে" যার বিষয়বস্তু হল, দায়িত্ব কার হাতে থাকবে, তার ভিত্তি হল নিম্নোক্ত আয়াতটি

"হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ ও রাসূলকে মেনে চলো এবং তাদেরকে মেনে চল যাদেরকে তোমাদের মধ্য থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে (ঊলা' আল-আমর) " (কুরআন ৪:৫৯)।

সুন্নিদের কাছে, ঊলা' আল-আমর হল শাসকগণ (খলিফা ও রাজা-বাদশাহগণ) কিন্তু শিয়াদের কাছে এই কথার অর্থ হল ইমামগণ।"

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় আলেমগণ উসূলুল ঈমান গ্রন্থে বলেন, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উপস্থাপিত দলীল-প্রমাণ অনুসারে গুনাহের কাজ ছাড়া অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে ইমাম ও শাসকগোষ্ঠির আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

  1. গুনাহর কাজ ছাড়া সর্বাবস্থায় শোনা ও মানা ওয়াজিব।
  2. শাসকগোষ্ঠী যদি নসীহত কবুল না করে তারপরও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা।
  3. যে কেউ শরী'আত সমর্থিত পদ্ধতিতে শাসকগোষ্ঠীকে নসীহত করল এবং তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করল সে গুনাহ থেকে মুক্তি পেল।
  4. ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টি করা নিষেধ, অনুরূপভাবে যে সমস্ত কারণে ফিত্না বা অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে তা করাও নিষেধ।
  5. যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতাশীলদের থেকে এমন কোনো সুস্পষ্ট কুফুরী প্রকাশ না পাবে যা কুফুরী হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রকার দ্বিমত থাকবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না।
  6. কথা, কাজ ও বিশ্বাসে কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শে পরিচালিত মুসলিমদের জামা'আতকে আঁকড়ে ধরে থাকা ওয়াজিব, তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে, তাদের পথে চলতে হবে, হক ও ন্যায়ের পথে তাদের কথা এক রাখার ব্যাপারে আগ্রহ থাকতে হবে। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না বা তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা যাবে না।

অত্যাচারী ও পাপাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিরোধিতা করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নে সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেন, "ইসলামী শরিয়ার একটি সূত্র হচ্ছে-“মন্দকে মন্দতর দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে না। বরং যা দিয়ে মন্দকে নির্মূল করা যাবে, কিংবা কমানো যাবে তা দিয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করতে হবে”। তাই যে শাসক সুস্পষ্ট কুফুরীতে লিপ্ত তাকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় তাদের যদি এমন সক্ষমতা থাকে যা দিয়ে তারা তাকে পদচ্যুত করতে পারবে, তার বদলে একজন ভাল ও নেককার শাসক বসাতে পারবে এবং এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরনের কোন বিশৃংখলা তৈরী হবে না, এ শাসকের অনিষ্টের চেয়ে বড় কোন অনিষ্টের শিকার হবে না— তাহলে এতে কোন বাধা নেই। পক্ষান্তরে, এ বিদ্রোহের মাধ্যমে যদি বড় ধরনের বিশৃংখলা তৈরী হয়, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, নিরপরাধ মানুষ জুলুম ও গুপ্ত হত্যার শিকার হয়... ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে বিদ্রোহ করা জায়েয হবে না। বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে, শাসকের ভাল নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে। শাসককে উপদেশ দিতে হবে, ভাল কাজ করার দিকে ডাকতে হবে। মন্দকে কমানো ও ভালকে বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এটাই সরল পথ; যে পথ অনুসরণ করা কর্তব্য। কারণ এ পথে মুসলমানদের জন্য সাধারণ কল্যাণ নিহিত; এ পথে ক্ষতির দিক কম, কল্যাণের দিক বেশি; এ পথে আরও বড় অকল্যাণ থেকে মুসলমানদের নিরাপত্তা নিহিত আছে।"

শরিয়াহ ও প্রশাসনিক-ব্যবস্থা (সিয়াসাত)

মধ্যযুগের শেষের দিক থেকে, সুন্নি ফিকহে সিয়সা শারিয়াহর মতবাদকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়, যার আক্ষরিক অর্থ শরিয়াহ অনুসারে শাসনব্যবস্থা এবং কখনও কখনও একে ইসলামী আইনের রাজনৈতিক মাত্রাও বলা হয়ে থাকে। এর লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ব্যবহারিক চাহিদার সঙ্গে ইসলামী আইনের মেলবন্ধন ঘটানো।

শিয়া প্রথা

শিয়া ইসলামে, শাসকদের প্রতি তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে - শাসকের সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতা, শাসককে চ্যালেঞ্জ করার রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতা - "যুগ যুগ ধরে শিয়া উলামাদের লেখনী" "এই তিনটি মনোভাবের সকল উপাদান" প্রদর্শন করেছে।

খারেজি প্রথা

কিছু মুসলিম লেখকের মতে, ইসলামের মধ্যে চরমপন্থা ৭ম শতাব্দীতে খারিজিদের কাছ থেকে শুরু হয়। মূলত তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে, তারা চরম মতবাদ গড়ে তুলেছিল যা তাদের মূলধারার সুন্নি এবং শিয়া উভয় মুসলমানদের থেকে আলাদা করে। খারিজিরা বিশেষভাবে তাকফির এর প্রতি উগ্রপন্থা অবলম্বন করার জন্য সুপরিচিত ছিল, যেখানে তারা অন্যান্য মুসলমানদের অবিশ্বাসী বলে ঘোষণা করেছিল এবং তাই তাদের হত্যার যোগ্য বলে মনে করেছিল।

খারেজিদের আবির্ভাবের ব্যাপারে ইসলামী নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটি হাদিসকে আলেমগণ উল্লেখ করে থাকেন।

আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, ইয়ামান থেকে আলী (রা) মাটি মিশ্রিত কিছু স্বর্ণ প্রেরণ করেন। তিনি উক্ত স্বর্ণ ৪ জন নওমুসলিম আরবীয় নেতার মধ্যে বণ্টন করে দেন। তখন বসা চক্ষু, উচু গাল, বড় কপাল ও মুন্ডিত চুল, যুল খুওয়াইসিরা নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহকে ভয় করুন, আপনি তো বে ইনসাফি করলেন! তিনি বলেন, দুর্ভোগ তোমার! পৃথিবীর বুকে আল্লাহকে ভয় করার সবচেয়ে বড় অধিকার কি আমার নয়? আমি যদি আল্লাহর অবাধ্যতা করি বা বে-ইনসাফি করি তবে আল্লাহর আনুগত্য এবং ন্যায় বিচার আর কে করবে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে গণ্য করলেন, আর তোমরা আমার বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতে পারছ না! এরপর লোকটি চলে গেল। তখন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি লোকটিকে (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে ধর্মত্যাগ ও কুফরী করার অপরাধে) মৃত্যুদন্ড প্রদান করব না? তিনি বলেন, না। হয়তবা লোকটি সালাত আদায় করে। খালিদ (রা) বলেন, কত মুসল্লীই তো আছে যে মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখব বা তাদের পেট ফেড়ে দেখব। অতঃপর তিনি গমনরত উক্ত ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, এ ব্যক্তির অনুগামীদের মধ্যে এমন একদল মানুষ বের হবে যারা সদাসর্বদা সুন্দর-হৃদয়গ্রাহীভাবে কুরআন তিলাওয়াত করবে, অথচ কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তীর যেমন শিকারের দেহ ভেদ করে বেরিয়ে চলে যায়, এরাও তেমনি ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে চলে যাবে। তারা ইসলামে অনুসারীদের হত্যা করবে এবং প্রতিমা-পাথরের অনুসারীদের ছেড়ে দেবে। আমি যদি তাদেরকে পাই তবে সামূদ সম্প্রদায়কে যেভাবে নির্মুল করা হয়েছিল সেভাবেই আমি তাদেরকে হত্যা করে নির্মুল করব।

খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বইটিতে উপরোক্ত হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,

খারিজী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ডেই আমরা ইসলামের ইতিহাসে উগ্রতা ও সন্ত্রাসের প্রথম ঘটনা দেখতে পাই। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬খৃ) ইসলামী রাষ্ট্রে্র রাষ্ট্রপ্রধান খলীফা উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। বিদ্রোহীদের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মত কেউ ছিল না। তাঁরা রাজধানী মদীনার সাহাবীগণকে এ বিষয়ে চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আলী (রা) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাপতি ও গভর্নরগণ আলীর আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু উসমান (রা) কর্তৃক নিযুক্ত সিরিয়ার গভর্নর মু‘আবিয়া (রা) আলীর আনুগত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দাবি জানান যে, আগে খলীফা উসমানের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। আলী (রা) দাবি জানান যে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বে বিদ্রোহীদের বিচার শুরু করলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে, কাজেই আগে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি ঘোরালো হয়ে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। সিফ্ফীনের যুদ্ধে উভয়পক্ষে হতাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য একটি সালিসী মজলিস গঠন করেন। এ পর্যায়ে আলীর (রা) অনুসারীদের মধ্য থেকে কয়েক হাজার মানুষ আলীর পক্ষ ত্যাগ করেন। এদেরকে ‘খারিজী’ অর্থাৎ দলত্যাগী বা বিদ্রোহী বলা হয়। এরা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, যারা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইন্তেকালের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবক। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান আবেগী মুসলিম। সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় ও সরাদিন যিক্র ও কুরআন পাঠে রত থাকার কারণে এরা ‘কুর্রা’ বা ‘কুরআনপাঠকারী দল’ বলে সুপরিচিত ছিলেন। এরা দাবি করেন যে, একমাত্র কুরআনের আইন ও আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই চলবে না। আল্লাহর নির্দেশ, অবাধ্যদের সাথে লড়তে হবে। আল্লাহ বলেছেনঃ (وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ) ‘‘মুমিনগণের দু দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘন করলে তোমরা জুলুমকারী বা সীমালঙ্ঘনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’’ এখানে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, সীমালঙ্ঘনকারী দলের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, যতক্ষণ না তারা ফিরে আসে। মু‘আবিয়ার (রা) দল সীমালঙ্ঘনকারী, কাজেই তাদের আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আত্মসমর্পনের আগেই যুদ্ধ থামানো বা এ বিষয়ে মানুষকে সালিস বানানোর অর্থই আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার ব্যতিক্রম বিধান দেওয়া। এছাড়া আল্লাহ বলেছেন: (إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ) ‘‘হুকুম শুধু আল্লাহরই।’’ কাজেই মানুষকে ফয়সালা করার দায়িত্ব প্রদান কুরআনের নির্দেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আল্লাহ আরো বলেছেন: (وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) ‘‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’ আলী ও তার অনুগামীরা যেহেতু আল্লাহর নাযিল করা বিধান মত মু‘আবিয়ার সাথে যুদ্ধ না চালিয়ে, সালিসের বিধান দিয়েছেন, সেহেতু তাঁরা কাফির। তারা দাবি করেন, আলী (রা), মু‘আবিয়া (রা) ও তাঁদের অনুসারীরা সকলেই কুরআনের আইন অমান্য করে কাফির হয়ে গিয়েছেন। কাজেই তঁদের তাওবা করতে হবে। তাঁরা তাঁদের কর্মকে অপরাধ বলে মানতে অস্বীকার করলে তারা তাঁদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। খারিজীরা তাদের মতের পক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করতে থাকেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী তাদেরকে এ মর্মে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, কুরআন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পারঙ্গম হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আজীবনের সহচর সাহাবীগণ। কুরআন ও হাদীসের তোমরা যে অর্থ বুঝেছ তা সঠিক নয়, বরং সাহাবীদের ব্যাখ্যাই সঠিক। এতে কিছু মানুষ উগ্রতা ত্যাগ করলেও বাকিরা তাদের মতকেই সঠিক বলে দাবি করেন। তারা সাহাবীদেরকে দালাল, আপোষকামী, অন্যায়ের সহযোগী ইত্যাদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। সালিসি ব্যবস্থা আলী (রা) ও মুআবিয়া (রা)-এর মধ্যকার বিবাদ নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হওয়াতে তাদের দাবি ও প্রচারণা আরো জোরদার হয়। তারা আবেগী যুবকদেরকে বুঝাতে থাকে যে, আপোসকামিতার মধ্য দিয়ে কখনো হক্ক প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। কাজেই দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনের নির্দেশ অনুসারে জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। ফলে বৎসর খানেকের মধ্যেই তাদের সংখ্যা ৩/৪ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৫/৩০ হাজারে পরিণত হয়। ৩৭ হিজরীতে মাত্র ৩/৪ হাজার মানুষ আলীর (রা) দল ত্যাগ করেন। অথচ ৩৮ হিজরীতে নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে আলীর বাহিনীর বিরুদ্ধে খারিজী বাহিনীতে প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য উপস্থিত ছিল। তারা মনে করে, যেহেতু আলী (রা) ও মুআবিয়া (রা) মুসলিম উম্মাহকে খোদাদ্রোহিতার মধ্যে নিমজ্জিত করেছেন, সেহেতু তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করলেই জাতি এ পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার পাবে। এজন্য আব্দুর রাহমান ইবনু মুলজিম নামে একব্যক্তি ৪০ হিজরীর রামাদান মাসের ২১ তারিখে ফজরের সালাতের পূর্বে আলী যখন বাড়ি থেকে বের হন, তখন বিষাক্ত তরবারী দ্বারা তাঁকে আঘাত করে। আলীর (রা) শাহাদতের পরে উত্তেজিত সৈন্যেরা যখন আব্দুর রাহমানের হস্তপদ কর্তন করে তখন সে মোটেও কষ্ট প্রকাশ করে না, বরং আনন্দ প্রকাশ করে। কিন্তু যখন তারা তার জিহবা কর্তন করতে চায় তখন সে অত্যন্ত আপত্তি ও বেদনা প্রকাশ করে। তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, আমি চাই যে, আল্লাহর যিক্র করতে করতে আমি শহীদ হব! এ গুপ্তঘাতককে প্রশংসা করে তাদের এক কবি ইমরান ইবনু হিত্তান (৮৪ হি) বলেন: ‘‘কত মহান ছিলেন সে নেককার মুত্তাকি মানুষটি, যিনি সে মহান আঘাতটি করেছিলেন! সে আঘাতটির দ্বারা তিনি আরশের অধিপতির সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই চান নি। আমি প্রায়ই তাঁর স্মরণ করি এবং মনে করি, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সাওয়াবের অধিকারী মানুষ তিনিই।’’ আলী (রা) ও অন্যান্য সাহাবী এদের নিষ্ঠা ও ধার্মিকতার কারণে এদের প্রতি অত্যন্ত দরদ অনুভব করতেন। তাঁরা এদেরেকে উগ্রতার পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারা তাদের ‘ব্রান্ডের’ ইসলাম বা ইসলাম সম্পর্কে তাদের নিজস্ব চিন্তা ও ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। আলীকে প্রশ্ন করা হয়: এরা কি কাফির? তিনি বলেন, এরা তো কুফরী থেকে বাঁচার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বলা হয়, তবে কি তারা মুনাফিক? তিনি বলেন, মুনাফিকরা তো খুব কমই আল্লাহর যিক্র করে, আর এরা তো রাতদিন আল্লাহর যিক্রে লিপ্ত। বলা হয়, তবে এরা কী? তিনি বলেন, এরা বিভ্রান্তি ও নিজ-মত পূজার ফিতনার মধ্যে নিপতিত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য এদের সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। আরবী সাহিত্যে এদের কবিতা ইসলামী জযবা ও জিহাদী প্রেরণার অতুলনীয় ভান্ডার।এদের ধার্মিকতা ও সততা ছিল অতুলনীয়। রাতদিন নফল সালাতে দীর্ঘ সাজদায় পড়ে থাকতে থাকতে তাদের কপালে কড়া পড়ে গিয়েছিল। তাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়ে গেলে শুধু কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজই কানে আসতো। কুরআন পাঠ করলে বা শুনলে তারা কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যেত। পাশাপাশি এদের হিংস্রতা ও সন্ত্রাস ছিল ভয়ঙ্কর। ৩৭ হিজরী থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এদের সন্ত্রাস, হত্যা ও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ৬৪-৭০ হিজরীর দিকে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর ও উমাইয়া বংশের শাসকগণের মধ্যে যুদ্ধে তারা আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরকে সমর্থন করে। কারণ তাদের মতে, তিনিই সত্যিকার ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন উসমান (রা) ও আলী (রা)-কে কাফির বলতে অস্বীকার করলেন, উপরন্তু তাঁদের প্রশংসা করলেন তখন তারা তার বিরোধিতা শুরু করে। ৯৯-১০০ হিজরীর দিকে উমাইয়া খলীফা উমার ইবনু আব্দুল আযীয তাদের ধার্মিকতা ও নিষ্ঠার কারণে তাদেরকে বুঝিয়ে ভাল পথে আনার চেষ্টা করেন। তারা তাঁর সততা, ন্যায়বিচার ও ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণের বিষয়ে একমত পোষণ করে। তবে তাদের দাবি ছিল, উসমান (রা) ও আলী (রা)-কে কাফির বলতে হবে, কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত বিধান প্রদান করেছন। এছাড়া মু‘আবিয়া (রা) ও পরবর্তী উমাইয়া শাসকদেরকেও কাফির বলতে হবে, কারণ তারা আল্লাহর বিধান পরিত্যাগ করে শাসকদের মনগড়া আইনে দেশ পরিচালনা করেন। যেমন, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজকোষের সম্পদ যথেচ্ছ ব্যবহারে শাসকের ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি। উমার ইবনু আব্দুল আযীয তাদের এ দাবী না মানাতে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁর নিজের শাসনকার্য ইসলাম সম্মত বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এরা মনে করত যে, ইসলামী বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলেই মুসলিম ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয়। তারা এরূপ কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা’ বা রাজনৈতিক পর্যায়ে ইসলামী বিধিবিধান তাদের ধারণামত ‘‘পরিপূর্ণ’’ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। এছাড়া তারা আলীকে কাফির মনে করেন না এরূপ সাধারণ অযোদ্ধা পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করতে থাকে।[14] উলে­খ্য যে, অধিকাংশ সাহাবী আলী (রা) ও মু‘আবিয়া (রা)-এর মধ্যকার রাজনৈতিক মতবিরোধ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইবনু সিরীন (১১০ হি) বলেন, ‘‘যখন ফিতনা শুরু হলো, তখন হাজার হাজার সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১০০ জন সাহাবীও এতে অংশ গ্রহণ করেন নি। বরং এতে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সংখ্যা ৩০ জনেরও কম ছিল।’’ এ সকল সাহাবী ও অন্যান্য সাহাবী-তাবিয়ী নৈতিকভাবে আলীর (রা) কর্ম সমর্থন করতেন। তাকে পাপী বা ইসলামলঙ্ঘনকারী বলতে কখনোই রাজি হতেন না। খারিজীগণ এদেরকেও কাফির বলে হত্যা করত। একটি নমুনা দেখুন! সাহাবী খাববার ইবনুল আরাত-এর পুত্র আব্দুল্লাহ তাঁর স্ত্রী পরিজনদের নিয়ে পথে চলছিলেন। খারিজীগণ তাঁকে উসমান (রা) ও আলী (রা) সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি তাঁদের সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করেন এবং সন্ত্রাস ও হত্যার ভয়ানক পরিণতির বিষয়ে হাদীস বলেন। তখন তারা তাঁকে নদীর ধারে নিয়ে জবাই করে এবং তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী ও অন্যান্য নারী ও শিশুকে হত্যা করে। এসময়ে তারা একস্থানে বিশ্রাম করতে বসে। তথায় একটি খেজুর গাছ থেকে একটি খেজুর ঝরে পড়লে একজন খারিজী তা তুলে নিয়ে মুখে দেয়। তখন অন্য একজন বলে, তুমি মূল্য না দিয়ে পরের দ্রব্য ভক্ষণ করলে? লোকটি তাড়াতাড়ি খেজুরটি উগরে দেয়। আরেকজন খারিজী একটি শূকর দেখে তার দেহে নিজের তরবারী দিয়ে আঘাত করে। তৎক্ষণাৎ তার বন্ধুরা প্রতিবাদ করে বলে, এতো অন্যায়, তুমি এভাবে আল্লাহর যমিনে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছ ও পরের সম্পদ নষ্ট করছ! তখন তারা শূকরের অমুসলিম মালিককে খুঁজে তাকে টাকা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়। এভাবে তারা অমুসলিমদের বিষয়ে ইসলামের উদারতা গ্রহণ করছে, সামান্য একটি খেজুরের বিষয়ে বান্দার হক্ক নষ্ট করাকে ভয় পাচ্ছে, অথচ ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমকে বিভিন্ন অযুহাতে কাফির বলে ইসলামের নামে তাকে হত্যা করছে এবং নিরস্ত্র নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করছে।

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর খারেজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাপারে বলেন: (১) ইসলামের নির্দেশনা বা কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে নিজেদের বুঝকেই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা। এক্ষেত্রে সাহাবীগণের মতামতের গুরুত্ব অস্বীকার করা। (২) হাদীস মানলেও সুন্নাত বা আলোচ্য ও বিতর্কিত বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর প্রায়োগিক কর্ম ও কর্মপদ্ধতির গুরুত্ব অস্বীকার করা। (৩) পাপের কারণে মুসলিমকে কাফির বলা। (৪) কাফির হত্যার ঢালাও বৈধতা দাবি করা। (৫) রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শরয়ী গুরুত্ব অস্বীকার করা। (৬) রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পাপের কারণে রাষ্ট্রকে কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করা। (৭) এরূপ রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যকারী নাগরিকদেরকে কাফির বলা। (৮) এরূপ কাফির রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ বলা। (৯) জিহাদকে ফরয আইন, বড় ফরয ও দীনের রুকন বলে দাবি করা। (১০) ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের নামে শাস্তি প্রদান। (১১) তাদের মতের বিরোধী সকল আলিমকে অবজ্ঞা করা।

আধুনিক যুগ

ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের প্রতিক্রিয়া

১৯ শতকের সময়কালে, মুসলিম বিশ্বের ইউরোপীয় উপনিবেশকরণের পাশাপাশি একই সময়ে ফরাসিদের আলজেরিয়া বিজয় (১৮৩০), ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন (১৮৫৭), ককেশাস (১৮২৮)ও মধ্য এশিয়ায় (১৮৩০-১৮৯৫) রুশ বহিরাক্রমণ সংঘটিত হয়, এবং বিংশ শতাব্দীতে চূড়ান্তভাবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ও বিলুপ্তি ঘটে (১৯০৮-১৯২২)।


ইসলামী রাষ্ট্রের আধুনিক রাজনৈতিক আদর্শ

মধ্যযুগীয় পণ্ডিত মতামত দ্বারা প্রদত্ত বৈধতা ছাড়াও, সফল ইসলামী সাম্রাজ্যের দিনগুলির জন্য নস্টালজিয়া পরবর্তীতে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার অধীনে উন্মোচিত হয়েছিল। এই নস্টালজিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে ইসলামী আইন প্রধান।

গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা

সাধারণ মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি
  • গণতান্ত্রিক মতবাদসমূহের সমর্থন, যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্বাস করা হয় যে, সেগুলো ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে জনকল্যাণমূলক ভূমিকা রাখতে পারে, উদাহরণস্বরূপ আরব বসন্তের গনঅভ্যুত্থানসমূহে অংশগ্রহণকারী বহু আন্দোলনকারী;
  • নির্বাচনের মত গণতান্ত্রিক পন্থার সমর্থন, পাশাপাশি পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের কিছু দৃষ্টিভঙ্গিকে শরিয়তের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করে সেগুলোর প্রতি ধর্মীয় ও নৈতিক আপত্তি, উদাহরণস্বরূপ ইউসুফ আল-কারজাভির মত ইসলামী পণ্ডিতগণ;
  • গণতন্ত্রকে পশ্চিমা আমদানি হিসেবে প্রত্যাখ্যান এবং ঐতিহ্যবাহী ইসলামী প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমর্থন, যেমন শূরা (আলোচনাসভা) ও ইজমা (ঐক্যমত্য), উদাহরণস্বরূপ পূর্ণাঙ্গ রাজতন্ত্র ও মৌলবাদী ইসলামী আন্দোলনসমূহের সমর্থকগণ;
  • এই বিশ্বাস করা যে, গণতন্ত্রের জন্য ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, মুসলিম বিশ্বের একটি সংখ্যালঘু অংশ এই মত ধারণ করে থাকে।
সালাফি দৃষ্টিভঙ্গি

সালাফি আলেমগণ গনতন্ত্রকে হারাম বলে মত দেন, কিন্তু ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসার ও ভোট দেওয়ার সুযোগকে বৈধতা দেন এবং দুই খারাপের মাঝখানে উত্তমকে বেছে নেওয়ার জন্য ভোট দেওয়াকে উৎসাহিত করেন, এসব আলেমদের মধ্যে রয়েছেন শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বায, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে উসাইমিন, আব্দুল্লাহ আল-গুদাইয়্যান, আব্দুল্লাহ কুয়ুদ, আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, সৌদি আরবের বয়োজ্যেষ্ঠ আলেমগণঃ গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ আশ-শাইখ, শায়খ আবদুল মুহসিন আল-আবাদ, শায়খ ওয়াসিউল্লাহ আব্বাস এবং সৌদি আরবের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আলেমদের ফতোয়া প্যানেল, "ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া জারি করার জন্য স্থায়ী কমিটি", সকলেই মুসলমানদের ভোট দিতে উৎসাহিত করার অনুরূপ আহ্বানের প্রতিধ্বনি করেছেন।

ইসলামী রাজনৈতিক তত্ত্বসমূহ
  • প্রত্যাখ্যানবাদী ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, যা সায়্যিদ কুতুব ও আবুল আলা মউদুদী দ্বারা সম্প্রসারিত হয়েছে।
  • মধ্যমপন্থী ইসলামী অভিমত, যা মাসলাহা (জনগণের মতামত), আদল (ন্যায়বিচার) ও শূরার উপর গুরুত্বারোপ করে। হাসান আল-তুরাবী, রশিদ আল-গান্নুশি, ও ইউসুফ আল-কারজাভি এই অভিমতকে ভিন্নভিন্নভাবে প্রচার করে থাকেন।
  • উদারপন্থী ইসলামী অভিমত যা মুহাম্মাদ আব্দুহুর ধর্মকে বোঝার ক্ষেত্রে কার্যকারণের ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপের দ্বারা প্রভাবিত।

২০শ ও ২১শ শতক

সমসাময়িক আন্দোলনসমূহ

ইসলামের কিছু সাধারণ রাজনৈতিক স্রোতধারার মধ্যে রয়েছে:

  • সুন্নি সনাতন মতবাদ
  • মৌলবাদী সংস্কারবাদ বা পুনর্জাগরণ
  • ইসলামপন্থা বা রাজনৈতিক ইসলাম
  • ইসলামের অধীনে উদারপন্থী আন্দোলনসমূহ
সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ
Collection James Bond 007

আরও দেখুন

  • রাজনৈতিক ইসলাম
  • ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা
  • ইসলামবাদ
  • সর্ব-ইসলামবাদ
  • খেলাফত
  • ইসলামি রাজতন্ত্র
  • ইসলামী গণতন্ত্র
  • ইসলামি সমাজতন্ত্র
  • সালাফি আন্দোলন
  • সুফি-সালাফি সম্পর্ক
  • শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক
  • ইসলামী অর্থনীতি
  • ইসলামী ফৌজদারি (অপরাধমূলক) বিধিমালা
  • ইসলামী পারিবারিক আইনশাস্ত্র
  • ইসলামী সন্ত্রাসবাদ
  • ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা

টীকা


তথ্যসূত্র


উৎস

The following sources generally prescribe to the theory that there is a distinct 20th-century movement called Islamism:

  • "Children of Abraham: An Introduction to Islam for Jews" Khalid Duran with Abdelwahab Hechiche, The American Jewish Committee and Ktav, 2001
  • "The Islamism Debate" Martin Kramer, 1997, which includes the chapter The Mismeasure of Political Islam
  • "Liberal Islam: A Sourcebook", Charles Kurzman, Oxford University Press, 1998
  • "The Challenge of Fundamentalism: Political Islam and the New World Disorder", Bassam Tibi, Univ. of California Press, 1998

The following sources challenge the notion of an "Islamist movement":

  • Edward Said, Orientalism
  • Merryl Wyn Davies, Beyond Frontiers: Islam and Contemporary Needs
  • G. H. Jansen, Militant Islam, 1980
  • Hamid Enyat, Modern Islamic Political Thought

These authors in general locate the issues of Islamic political intolerance and fanaticism not in Islam, but in the generally low level of awareness of Islam's own mechanisms for dealing with these, among modern believers, in part a result of Islam being suppressed prior to modern times.

আরও পড়ুন

On democracy in the Middle East, the role of Islamist political parties and the War on Terrorism:

  • Ayoob, Mohammed. The Many Faces of Political Islam: Religion and Politics in the Muslim World. University of Michigan Press, 2007.
  • Blecher, Robert "Free People Will Set the Course of History: Intellectuals, Democracy and American Empire", Middle East Report (March 2003).
  • Remarks by the President at the 20th Anniversary of the National Endowment for Democracy, United States Chamber of Commerce, Washington, D.C., "President Bush Discusses Freedom in Iraq and Middle East", 6 November 2003.
  • Fisk, Robert "What Does Democracy Really Mean In The Middle East? Whatever the West Decides", The Independent, 8 August 2005.
  • Gambill, Gary "Jumpstarting Arab Reform: The Bush Administration's Greater Middle East Initiative", Middle East Intelligence Bulletin (Vol. 6, No. 6-7, June/July 2004).
  • Gergez, Fawaz "Is Democracy in the Middle East a Pipedream?", Yale Global Online, April 25, 2005.
  • Hayajneh, Adnan M. "The U.S. Strategy: Democracy and Internal Stability in the Arab World", Alternatives (Volume 3, No. 2 & 3, Summer/Fall 2004).
  • Marina Ottoway, et al., "Democratic Mirage in the Middle East", Carnegie Endowment for Ethics and International Peace, Policy Brief 20 (October 20, 2002).
  • Marina Ottoway and Thomas Carothers, "Think Again: Middle East Democracy", Foreign Policy (Nov./Dec. 2004).
  • Raja, Masood Ashraf. "Muslim Modernity: Poetics, Politics, and Metaphysics". Gabriele Marranci, ed. Muslim Societies and the Challenge of Secularization: An Interdisciplinary Approach. Aberdeen: Springer, 2010: 99–112.
  • Wright, Steven (2007). The United States and Persian Gulf Security: The Foundations of the War on Terror. Ithaca Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৬৩৭২-৩২১-৬.

বহিঃসংযোগ

  • Islam and Politics from the Dean Peter Krogh Foreign Affairs Digital Archives
  • Liberal Democracy and Political Islam: The Search for Common Ground
  • The Ideology of Terrorism and Violence in Saudi Arabia: Origins, Reasons and Solution
  • Evaluating the Islamist movement by Greg Noakes, an American Muslim who works at the Washington Report.
  • Muslim scholars face down fanaticism by Aicha Lemsine, an Algerian journalist and author.
  • Peter Krogh discuses Islam and politics with John L. Esposito and Mary Jane Deeb ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ আগস্ট ২০১১ তারিখে on Great Decisions (1994).
  • সমাজ সংস্কারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব, লেখক: মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী, সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, প্রকাশনায়: Islamic Propagation Office in Rabwah, (রিয়াদ, সৌদি আরব)
  • নেতৃত্বের মোহ, মূলঃ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, অনুবাদঃ আব্দুল মালেক - হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে
  • নেতৃত্ব এক মহান দায়িত্ব - লেখকঃ কামাল উদ্দীন মোল্লা - সম্পাদনাঃ আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া
  • ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ - নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর - অনুবাদঃ আব্দুল মালেক - হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে
  • শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা - আব্দুর রহমান বিন আব্দুল খালেক - অনুবাদঃ আব্দুল মালেক - হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে
  • জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের অপরিহার্যতা - হাফেয বিন মুহাম্মাদ আল-হাকামী - অনুবাদঃ মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম - হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে
  • ইকামতে দ্বীন, পথ ও পদ্ধতি - মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব - হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে
  • ভ্রান্তির বেড়াজালে ইকামতে দ্বীন - মুজাফফর বিন মহসিন - বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুব সংঘ
  • ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ - খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর - আস সুন্নাহ পাবলিকেশন্স
  • ইসলাম শিক্ষা, প্রথম পত্র, কোর্স কোড HSC 1807, এইচএসসি প্রোগ্রাম, মে ২০১৫, ইউনিট ৮ঃ ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়[টীকা ১]

পাদটীকা


Text submitted to CC-BY-SA license. Source: ইসলামে রাজনীতি by Wikipedia (Historical)

Articles connexes


  1. ইসলাম ও আধুনিক রাজনীতি
  2. ইসলাম ও রাজনীতি
  3. ইসলামি গণতন্ত্র
  4. ফিকহ
  5. বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
  6. রাজনীতি
  7. বাংলাদেশের রাজনীতি
  8. ইসলামি পরিভাষাকোষ
  9. বাঙালি ইসলামি ব্যক্তিত্বের তালিকা
  10. ইসলামবাদ
  11. ইসলামে যৌনতা
  12. ইসলামি ফৌজদারি বিধিমালা
  13. ইসলামি ধর্মতত্ত্ব
  14. শরিয়ত
  15. ইকামতে দ্বীন
  16. ইসলামের নবি ও রাসুল
  17. ইসলামি সংস্কৃতি
  18. মধ্যপন্থা (দ্ব্যর্থতা নিরসন)
  19. আবুল হাশিম
  20. ইসলামি সাহিত্য


INVESTIGATION