![ইসহাক আল গাজী ইসহাক আল গাজী](https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/0/0f/Circle_-_Darul_Uloom_Deoband.png/400px-Circle_-_Darul_Uloom_Deoband.png)
শাহ মুহাম্মদ ইসহাক আল গাজী ( ১৯১৭ — ২০০৬ ) ছিলেন একজন বাংলাদেশি ইসলামি পণ্ডিত, হানাফি সুন্নি আলেম, আরবি কবি, ধর্মীয় লেখক এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস ছিলেন। তিনি হারুন ইসলামাবাদীর অগ্রজ।
ইসহাক আল গাজী ১ জানুয়ারি ১৯১৭ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার আশিয়া ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ ইসমাঈল ও মাতা উম্মে হাবিবা। হারুন ইসলামাবাদী তার অনুজ।
পাঁচ বছর বয়সে মাতুলালয়ে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। তার পিতা ও একজন আত্মীয়ের অধীনে তিনি কুরআন শিক্ষা করতেন। পাশাপাশি নেজাম সওদাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেখা করেন।
এরপর ১৯৩১ সালে তিনি আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এখানে মুফতি আজিজুল হক তার শিক্ষক ছিলেন।
১৯৩৮ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। দেওবন্দ পৌঁছার পর তার সঙ্গীরা ভর্তি পরীক্ষা জটিলতায় মাজাহির উলুম, সাহারানপুরে চলে যান। তিনি সাহারানপুর যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর ইজাজ আলী আমরুহীর অধীনে ভর্তি পরীক্ষায় স্কলার মার্ক পেয়ে তিনি দেওবন্দে পড়ালেখা শুরু করেন। হাদীস, ফিকহ ও দর্শনের উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৪২ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেওবন্দে তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে : হুসাইন আহমদ মাদানি, ইজাজ আলী আমরুহী, মুহাম্মদ ইদ্রিস কান্ধলভি, ইব্রাহিম বলিয়াভী, মুহাম্মদ শফী উসমানী সহ প্রমুখ। এছাড়াও তিনি কারী মুহাম্মদ তৈয়ব ও শাব্বির আহমেদ উসমানির ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতেন।
দেওবন্দ থাকাবস্থায় তিনি আশরাফ আলী থানভী, হিফজুর রহমান সিওহারভি, ওজাইল গুল পেশওয়ারী ও আসাদুল্লাহ সাহারানপুরীর সান্নিধ্যে যেতেন।
এসময় তিনি আশরাফ আলী থানভীর খলিফা নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা নূর বকসের সাথে পত্রে যোগাযোগ করে আধ্যাত্মিক শিক্ষা নেন। তার মৃত্যুর পর তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীর সাবেক আচার্য ও আশরাফ আলী থানভীর খলিফা শাহ আব্দুল ওয়াহহাবের নিকট বায়’আত হন। তিনি ১৯৫১ সালে ইসহাক আল গাজীকে খেলাফত প্রদান করেন।
১৯৪২ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে পিতার প্রতিষ্ঠিত আশিয়া ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষাকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি আল জামিয়াতুল আরবিয়া নছিরুল ইসলাম নাজিরহাটে হাদীসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৩ বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৪৬ সালে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ায় চলে যান। ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৬৫ সালে আগ্রাবাদ হাজীপাড়া আজিজিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসায় যোগদান করেন। সেখানে এক বছর শিক্ষকতার পর ১৯৬৭ সালে তিনি আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরিতে চলে যান। ৩ বছর জামিয়া জিরিতে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭০ সালে তিনি বাড়িতে চলে যান। ১৯৭২ পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই অবস্থান করেন, এই সময়ও তিনি জামিয়া পটিয়ায খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে শায়খুল হাদিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি জামিয়া হাইলধর মাদ্রাসায় চলে যান। ১৯৮৭ সালে পুনরায় জামিয়া বাবুনগরে চলে আসেন। ১৯৯২ সালে তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ায় যোগদান করেন। তখন থেকে আমৃত্যু পটিয়াতেই ছিলেন।
নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে তিনি খাদেমুল ইসলাম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিদের শিক্ষার জন্য একটি শিক্ষাকোর্স চালু করেন।
ইসলামের বিশুদ্ধ আদর্শ প্রচার, ইসলাম বিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রতিহতকরণের লক্ষ্যে ইসহাক আল গাজী ও তার অনুজ ইউসুফ আশিয়াভীর যৌথ উদ্যোগে এই সেবামূলক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসহাক আল গাজী জামিয়া পটিয়ায় থাকাকালীন এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি এর মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠের মাধ্যমে বই ছাপিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে :
মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নতির লক্ষ্যে তিনি মজলিশে হেদায়েত নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ অধ্যায়নকালীন তার উস্তাদ ছিলেন হুসাইন আহমদ মাদানি। তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি ছিলেন। জমিয়তের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিছিল-মিটিংসহ সর্বপ্রকার আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি এ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করেন। মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী ও ছিদ্দিক আহমদ মুক্তিযুদ্ধকে “জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করলে তিনি সরব ভূমিকা পালন করেন।
তিনি আঞ্জুমানে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কাফের ঘোষণার দাবিতে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
বাংলাদেশের হাইকোর্টে ফতওয়াকে নিষিদ্ধ করে রায় প্রদান করা হলে ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। তিনি এর শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারক নিযুক্ত হন। বাহ্মণবাড়িয়ায় এ কমিটির এক সম্মেলনে ৬ জন নিহত হয়। তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার ফতওয়া বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
১৯৪৬ সালে নাজিরহাটে মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রার্থীর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাজিরহাট বড় মাদ্রাসায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তিনি এই পরিস্থিতি শান্ত করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে হঠাৎ বেরলভীরা পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় তিনি অপ্রস্তুত ছিলেন। ফলে এ ঘটনায় তার বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায়। দেশের চিকিৎসায় ফল না হওয়ায় তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৬ মাস পর চিকিৎসা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাকে গাজী উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
২০০২ সালের ১৮ আগস্ট পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নে একটি হেফজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রতিযোগিতায় তাকে জাতীয় শায়খুল হাদিস উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৯ সালে তিনি হজ্জ পালন করেন। তার সর্বশেষ হজ্জ ছিল ২০০৪ সালে।
১৯৮৭ সালে আবুধাবির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মণ্ডলীর দাওয়াতে তিনি আবুধাবি সফর করেন। বিমানবন্দরে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মাগরিবের পর আবুধাবির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আহাদ বিন আব্দুল আজিজ আল মোবারকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়ে তাকে ধর্মীয় বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। তিনি এর সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করেন। প্রায় এক মাস পর তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মিয়ানমার সফর করেন। মিয়ানমারের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ মুসলমানরা তাকে সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি মিয়ানমারের বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। ২ সপ্তাহ অবস্থান করে তিনি মার্চ মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
তিনি ১৯৪৫ সালে চন্দনাইশ উপজেলার হারালস্থ আব্দুল হাকিমের প্রথম কন্যা মর্তুজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক।
তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে :
তার রচিত সানায়ে খাইরুল বারিয়্যাহ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য বই হিসেবে স্বীকৃত। এটি একটি কাব্যগ্রন্থ, যা তিনি ১ ঘণ্টায় রচনা করেছিলেন। তার অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে :
তিনি ২০০৬ সালের ১৮ মে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ঐদিন আসরের নামাযের পর জামিয়া পটিয়ার মাঠে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন জামিয়া পটিয়ার তৎকালীন আচার্য নূরুল ইসলাম কদীম। জানাযা শেষে তাকে মাকবারায়ে আযীযীতে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
Owlapps.net - since 2012 - Les chouettes applications du hibou